Guru drama written by Rabindranath Tagore গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশ্নোত্তর

 গুরু নাটকের প্রশ্ন ও উত্তর

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরু নাটকের প্রশ্ন ও সমাধান

একাদশ শ্রেণীর পাঠ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরু নাটকের প্রশ্ন ও উত্তর সম্পর্কে আলোচনা।


১) আমি পাপ করেছি - কথাটি কে কাকে বলেছে ? তাকে পাপ বলার কারণ কি? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও।

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গুরু নাট্যাংশে অচলায়তনের ছাত্র সুভদ্র পঞ্চকে উদ্দেশ্য করে আলোচ্য কথাটি বলেছেন। অচলায়তনের উত্তর দিকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা জানালিটিকে খুলে সুভদ্র বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আয়তনের নিয়ম অনুসারে এটাই ছিল সুভদ্রের পাপ কাজ। এই আয়তনে অজস্র নিয়ম কানুন কঠোরভাবে পালিত হতো। আয়তনের বাইরের বাতাস ভিতরে প্রবেশ করাকে তাঁরা ভয়ংকর পাপ বলে মনে করত।কেননা বাইরের বাতাস ভিতরে প্রবেশ করলে আয়তনের পরিবেশ কলুষিত হয়। সেইজন্য আয়তনের উপাধ্যায়গন সবসময় সতর্ক থাকেন। তাছাড়া আয়তনের উত্তর দিকে একজটা দেবীর অধিষ্ঠান। তাদের বিশ্বাস উত্তরের জানালা খুললে একজটা দেবী রুষ্ট হন। তাই সুভদ্র উত্তরদিকের জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকানোকে আয়তনের নিয়মানুসারে পাপ কাজ।

                 সুভদ্রের এই কাজকে আয়তনবাসীরা পাপ বলে মনে করলেও যুক্তি বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাছে তা কখনোই পাপ কাজ বলে মনে হবে না। কারণ এর মধ্যে কোন যুক্তি সম্মত ব্যাখ্যা মিলবে না। ৩৪৫ বছর যে জানালা পাপের ভয়ে কেউ কোনদিন খোলেননি, সুভদ্র সেই জানালা খুলে ফেলায় তার পাপ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তা নয়, সহজ কথায় বলা যায়, সুভদ্র যেমন প্রাচীন কুসংস্কারে কিছুটা আঘাত পেয়েছে অন্যদিকে উত্তর দিকের জানালা খুলে বাইরের নির্মল বাতাস আয়তনের পরিবেশকে বিশুদ্ধ করেছে। সুতরাং বলা যায় সুভদ্রের এই কাজ পাপ তো নয় বরং কিছুটা পূণ্য হয়েছে।

২) "পাপের এতটুকু গন্ধ পেয়ে মাছির মতো ছোটে"- কে কার সম্পর্কে বলেছে? এ প্রসঙ্গে বক্তার মানসিকতার পরিচয় দাও।

উঃ         আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গুরু' নাট্যাংশে অন্যতম চরিত্র পঞ্চক, উপাধ্যায় মশাই এর সম্পর্কে এ কথা বলেছে ।

         অচলায়তনের ছাত্র সুভদ্রের পাপের বর্ণনা প্রসঙ্গে আলোচ্য প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়েছে। আয়তনের নানা সংস্কার ও বিধিবিধান প্রচলিত। এই বিধানগুলি আয়তন বাসীরা অতি সতর্কতার সঙ্গে পালন করে। আর এই আয়তনের উপাধ্যায় মশাই হলেন আয়তনের নিয়ম নীতির বিধায়ক ও রক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হলে তাকে পাপ বলে ধরা হয়। এক জটা দেবী অধিকৃত উত্তর দিকের জানালাটি খুলে ফেলায় সুভদ্রের পাপ হয়েছে। এই পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উপাধ্যায় মশাই এর কাছে পাপের কথা জানতে গেলে পঞ্চক সুভদ্রকে প্রায়শ্চিত্য বিধানের হাত থেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু উপাধ্যায় মশাই সুভদ্রের কাছে তার পাপের বিবরণ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। আর এই ব্যাকুলতা দেখে পঞ্চক ব্যঙ্গ করে আলোচ্য কথাটি বলেছে। মাছি যেমন খাদ্য বস্তুর গন্ধ পেয়ে তার দিকে ছুটে যায় তেমনি উপাধ্যায়ও পাপের গন্ধ পেয়ে সুভদ্রের কাছে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন।


(৩) গুরু নাটকে মহাপঞ্চক এর চরিত্র আলোচনা কর। 

উঃ       গুরু নাটকে অচলায়তন ছিল মিথ্যা আচার-আচরণের ভারাক্রান্ত। সেই আয়তনেরই একজন উচ্চপদস্থ কর্তা ছিলেন মহাপঞ্চক। আয়তনের সমস্ত নিয়মগুলিকে কঠোরভাবে পালন করার পঞ্চমুখ ছিলেন তিনি। তাই আয়তনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই দিক থেকে তার চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্য গুলি আমরা লক্ষ্য করতে পারি। সেগুলি আলোচনা করা হলো। 

(ক) প্রথানুরাগ ও অহংকার বোধ --

               মহাপঞ্চক ছিলেন আয়তনের মন্ত্র নির্ভরতার মূল ধারক। তাই তিনি সেখানে গান সহ্য করতে পারতেন না। এদিক থেকে প্রথানুরাগের দিকটি ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে তেমনি পঞ্চক মহা পঞ্চক কে গান গাওয়ার কথা বললে মহা পঞ্চক তাকে ঠাট্টা বলে মনে করেছে। 'আমি মহা পঞ্চক গান ধরবো! ঠাট্টা আমার সঙ্গে'। এই উক্তির মধ্য দিয়ে তার অহংকারের দিকটি প্রকাশিত হয়েছে। 

(খ) শাস্ত্রজ্ঞানী --

         মহাপঞ্চক ছিলেন যথেষ্ট শাস্ত্রজ্ঞানী। আয়তনের সমস্ত মন্ত্র ছিল তার নখদর্পণে। সুভদ্রের জানালা খোলার জন্য তার কি শাস্তি হতে পারে, তিনি একমাত্র বলতে পারেন। তাছাড়া দাদা ঠাকুরের দল যূনকরা আয়তনের প্রাচীর খসিয়ে দিয়েছে শুনে তিনি দৈব বানিতেই আস্থা রাখার কথা বলেছেন।

(গ) নিঃসঙ্গ পরিণতি --

           নাটকের শেষে মহা পঞ্চক কে নিঃসঙ্গ বলেই মনে হয়। আয়তনের প্রাচীর ভেঙে গুরুর আগমন ঘটলে মহা পঞ্চক তা মেনে নিতে পারেন না। কারণ তিনি জানতেন আয়তনের প্রাচীর ফুটো করার ক্ষমতা কারোর নেই। লোহার দরজা ভাঙলে সূর্য, চন্দ্র নিভে যাবে। তাই সকলে গুরুকে মেনে নিলেও মহা পঞ্চক তা মেনে নিতে পারেননি।

          পরিশেষে বলা যায় শাস্ত্রজ্ঞ মহা পঞ্চকের গুরুকে অস্বীকার করার কোন যুক্তি নেই। কিন্তু তার মধ্যে আছে অবিচলিত নিষ্ঠা। তাকে মান্য করায় তিনি ক্ষমতা লিপ্সা হয়ে উঠেছিলেন ঠিকই কিন্তু শেষে একাকী হয়ে পড়ায় তার অহংকার চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় সকলেরই মনোহরণ করার ক্ষমতা রাখেন।    


(৪) গুরু নাটকের গুরুর যে স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখ।

উঃ       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরু নাটকে গুরুর স্বরূপ প্রসঙ্গে নানা কাল্পনিক মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। চাঞ্চকের কাছে গুরু হলেন মুক্ত পৃথিবীর ভগবান। তাই তাকে স্বাগত জানানোর জন্য জঞ্জালের মত পুঁথি সর্বস্ব ফেলে যেতে চেয়েছেন। আয়তনের স্বাস্থ্য পন্থীরা গুরুর জন্য মাঙ্গল্য নিয়ে সিংহদ্বার সাজাতে চেয়েছেন। আবার মহা পঞ্চক বিশ্বাস করেন মন্ত্রে ভুল হলে গুরু পঞ্চককে আয়তন থেকে দূর করে দেবে। স্থবির পত্বনের রাজা গুরুর জন্য জানালা বন্ধ করে শুদ্ধি মন্ত্র পাঠের কথা বলেছেন। যদিও আয়তন বাসীরা সকলে গুরুকে নিজ চোখে দেখেনি।

          রহস্য ময়তার আবরণ ছিন্ন করে যখন গুরুর আবির্ভাব ঘটে তখন তিনি হয়ে ওঠেন বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিলনের কারিগর। তাই দর্ভকদের কাছে তিনি গোশাই ঠাকুর, যুজকদের কাছে তিনি দাদা ঠাকুর, আচার্য এর কাছে তিনি গুরু। তিনি বিভিন্ন জনকদের কাছে নতুন রূপে ধরা দেন। তিনি বিশ্বাস করেন সকলের সঙ্গে সকলের মিলনে আত্মার মুক্তি ঘটে। সংস্কারের রুদ্ধ পরিবেশে মুক্তির প্রাণের উল্লাস তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তাই শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে যে স্বচ্ছ ও সত্য দৃষ্টি অচলায়তন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তাকে পূর্ণতা দিয়ে দাদা ঠাকুর বা গুরু বালকদের নিয়ে খোলা জায়গায় খেলতে যেতে চান। কারণ খোলা জায়গায় সব পাপ পালিয়ে যায়। এই ভাবেই গুরু নাটকে গুরুর স্বরুপ ধরা পড়েছে।


(৫) "ও আজ যেখানে বসেছে সেখানে তোমাদের তলোয়ার পৌঁছায় না"-সেখানে তলোয়ার না পৌঁছানোর কারণ কি?

উঃ         রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গুরু নাটকের আলোচ্য মন্তব্যটির বক্তা হলেন দাদা ঠাকুর। তিনি মহা পঞ্চক এর সম্পর্কে এই মন্তব্যটি করেছেন।

          দাদা ঠাকুরের নেতৃত্বে যুনকরা অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে ফেলার পরে একে একে সকলেই সেই পরিবর্তনকে মেনে নিতে শুরু করে। বাইরের আলো, বাতাস ও পাখির ডাকে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ছেলের দল ছুটে বেড়ায়। নীল আকাশের নিচে তারা মুগ্ধ ও রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। কিন্তু মহাপঞ্চ তার কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেনা। ফলে তার কথাবার্তা পাগলের প্রলাপ বলে মনে করে। তাই প্রথম যুনক গুরুকে মজা করে বন্দি করার কথা বলে। এই শাস্তি দান প্রসঙ্গে দাদাঠাকুর বা গুরু আলোচ্য প্রসঙ্গটি এনেছেন। 

        অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙেছে। মহাপঞ্চক একা হয়ে গেছে। কিন্তু নিজের ভাবনা থেকে কিছুতেই সরে আসতে পারেনি। দাদা ঠাকুর মহাপঞ্চক এর বিপরীতে থেকে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততাকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারেননি। তার মনে হয় যে নিষ্ঠা নিয়ে মহা পঞ্চককে তার জীবনাদর্শ পালন করে সেখানে তাকে শাস্তি দেওয়া দূরে থাক স্পর্শ করাও কোনভাবেই সম্ভব নয়। যদিও দাদা ঠাকুর তার উদার অভ্যুদয় একদিন মহাপঞ্চককে মানবতাবাদে পরিণত করে।


(৬) যুনকরা চাষ করে কেন? তাদের গানে এই চাষের আনন্দ কিভাবে ফুটে উঠেছে? 

উঃ        প্রকৃতি আমাদেরকে নানা উপহার দিয়েছে। সেগুলিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে জীবন প্রণালীকে উন্নত করে তোলাই আমাদের কাজ। গুরু নাটকে বর্ণিত যুনক জাতিকে নিম্ন শ্রেণীর বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা নাচ ,গান করে। সারাদিন খেটে চাষ করে। তারা সভ্য ও ভদ্র হয় না । তারা ভদ্র আচরণ ব্যবস্থা শেখেনি। তারা চাষ করে ফসল ফলায় আর অন্যান্য মানুষ তা গ্রহণ করে জীবন ধারণ করে। মাটিকে তারা খুব ভালোবাসে। এরা কঠোর পরিশ্রম করে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সমাজে সেবা করাই এদের কাজ।

          কাজই যুনকদের গর্ব। আর গানের মধ্য দিয়েই তাদের গর্ব প্রকাশ পায়। এরা গান গেয়েই কষ্টকে লাঘব করে এবং আনন্দে মেতে ওঠে।

                   "আমরা চাষ করি আনন্দে

                    মাঠে মাঠে বেলা কাটে

                   সকাল হতে সন্ধ্যে"।

গানের মধ্য দিয়ে এরা দুঃখ যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে পারে, কঠোর পরিশ্রম করতে পারে। গানের মধ্য দিয়েই এরা নতুন জীবন খুঁজে পায় এবং সকলকে মাতিয়ে রাখে। কোনো কাজে এদের লজ্জা নেই, ভয় নেই, দুঃখ নেই। যুনকদের গানে এভাবেই চাষের আনন্দের পরিচয় পাওয়া যায়।


(৭) "শিলা জলে ভাসে"- কে কোন প্রসঙ্গে একথা বলেছেন? 

উঃ       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গুরু নাটকের অন্তর্গত আলোচ্য উক্তিটির বক্তা হলেন মহা পঞ্চক। তিনি ব্যঙ্গ করে প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন। কঠিন পদার্থ শিলার ভর তার দ্বারা অপসারিত জলের তুলনায় অনেক বেশি বলে শিলা জলে ডুবে যায়, ভাসেনা। তাই কথাটি অবাস্তব। অচলায়তনের অন্যতম সদস্য বিসম্বর যখন মহাপঞ্চককে জানায় যে, শত্রুপক্ষের সৈন্য বা যুনকরা অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দিয়েছে। তখনই মহা পঞ্চক বিস্ময়ের সঙ্গে আলোচ্য কথাটি বলেছে।

        পাথর দিয়ে গড়া বিশাল শক্ত মন্ত্রপূত অচলায়তনের প্রাচীর কিভাবে ম্লেচ্ছরা ভেঙে ফেলল তা মহা পঞ্চকের বোধগম্য হয় না। অচলায়তনের অপরাধ বাড়তে বাড়তে চরমসীমায় পৌঁছেছিল। ফলে যুনকরা সেই আয়তনের প্রাচীর ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। শিলা জলে না ভাসলেও হনুমানের রাম নাম লেখা শিলায় ভর করে রাম লক্ষণ সহ বিশাল বানর সেনা লঙ্কায় পৌঁছে ছিল। অর্থাৎ বিশ্বাস ও আত্মশক্তি মানুষকে যে কোনো অসাধ্য সাধন করতে সাহায্য করে। এখানে সেই আত্মশক্তি ও গুরুর প্রতি বিশ্বাসী যুনকরা শক্তিরূপে রাজ করেছে।


Comments

Popular posts from this blog

কর্ভাস (Carvas)প্রফেসর শঙ্কুর ডায়রি

বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা তারতম্যের কারণগুলি আলোচনা কর।

আদর্শ ফুলের গঠন চিত্র ( দশম শ্রেণী)