ভারতবর্ষ
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
(১) "দেখতে দেখতে প্রচণ্ড উত্তেজনা ছড়ালো চারিদিকে"- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই উত্তেজনার বিবরণ দাও।
উঃ আলোচ্য অংশটি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ রচিত "ভারতবর্ষ" নামক ছোটগল্পংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। পৌষে বাদলার দুর্যোগ কাটার পর বট গাছের নিচে মৃত বদ বুড়িকে কয়েকজন হিন্দু গ্রামবাসী চৌকিদারের পরামর্শে নদীতে ফেলে আসে। বিকেলে দেখা যায় কয়েকজন মুসলমান সেই বুড়িকে কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে আসছে। ফলে বুড়ি হিন্দু না মুসলমান এই নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বচসা বেধে যায়।এবং ক্রমে ক্রমে প্রচন্ড সম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায় দু পক্ষের গ্রামবাসীরা ছুটে আসে। ফলে তর্কাতর্কি ক্রমশ বেড়ে চলে। এই অবস্থায় কয়েকজন লোক বুড়িসহ বাঁশের মাচা নিয়ে টানাটানি শুরু করে। দুই সম্প্রদায়ের জনতা একে অপরকে গালাগালি বর্ষণ করতে থাকে। মোল্লা সাহেব চিৎকার করে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করতে লাগলেন। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে চৌকিদার সাহেব একটি লাঠি নিয়ে দুই পক্ষের মাঝে দাঁড়িয়ে তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করতে থাকলেন। কোনো পক্ষ এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে তিনি সাবধান খবরদার বলে গর্জন করতে থাকলেন। কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার মুখেই বুড়ি ঘুম থেকে উঠে উত্তেজনায় জল ঢেলে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন।
(২) সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প হিসাবে "ভারতবর্ষ" ছোটগল্পটি কতখানি সার্থক তা আলোচনা কর।
উঃ প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ 'ভারতবর্ষ' নামক ছোটগল্পে মিথ্যা বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় ভাবাবেগ কিভাবে মানুষকে নিচে নামাতে পারে এবং কিভাবে তা বিধ্বংসী রূপ নিতে পারে তারই এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। নিজের ধর্ম ধর্মগ্রন্থ এবং নিজে ধর্মের মানুষদের পক্ষে থেকে অন্য ধর্মের মানুষ ও ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধাচারণ করাই হলো সাম্প্রদায়িকতা।
আলোচ্য গল্পাংশে দেখা যায় পৌষের অকাল দুর্যোগে এক বৃদ্ধা ভিখারিনীকে দীর্ঘ সময় ধরে মৃতবধ হয়ে থাকতে। ফলে তার মৃত্যু হয়েছে ভেবে দুই সম্প্রদায়ের গ্রামবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একদিকে মোল্লা সাহেবের উস্কানিতে মুসলমানরা এবং অন্যদিকে ভট্টাচার্য মশায়ের উস্কানিতে হিন্দুরা মার মুখো দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঠিক সেই সময়ই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বুড়িটি ক্রমে ক্রমে উঠে দাঁড়ায় তারপর দুই সম্প্রদায়ের মানুষের দিকে তাকিয়ে ফ্যাক করে হেসে ওঠে। শেষে তাকে হিন্দু না মুসলমান একথা জিজ্ঞাসা করা হলে তাকে গালাগাল দিয়ে সাম্প্রদায়িক অকারণ উত্তেজনায় জল ঢেলে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।
পরিশেষে বলা যায় ভারতবর্ষের দুই প্রধান ধর্ম সম্প্রদায় হল হিন্দু ও মুসলমান। এরা যেন একই বোটায় দুটি ফুল। কিন্তু ধর্মের ধজাধারী মৌলবাদীরা কিভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সাধারণ ধর্ম বিশ্বাসীদের উত্তেজিত করে তা গল্পাংশে চমৎকার ভাবে চিত্রিত হয়েছে। আর বুড়িটি হল জাগ্রত শুভ বোধ ও চেতনার প্রতীক। সেই জন্যই তিনি গল্পের জনতা ও পাঠককে নিয়ে যান অসাম্প্রদায়িক মহানুভব। তাই এদিক থেকে 'ভারতবর্ষ' নামক ছোট গল্পটি যথেষ্টই সার্থক হয়ে উঠেছে।
(৩) "আমি কে তা দেখতে পাচ্ছিস নে"-কোন প্রশ্নের উত্তরে বক্তা কেন এ কথা বলেছেন?
উঃ প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা রচিত ভারতবর্ষ নামক ছোটগল্পে বৃদ্ধাকে কেন্দ্র করে যখন মার মুখি উত্তেজিত হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় বৃদ্ধাকে হিন্দু না মুসলমান একথা জিজ্ঞাসা করলে বৃদ্ধা আলোচ্য কথাটি বলেছেন।।
আলোচ্য গল্পে বর্ণিত বৃদ্ধা ছিল কুজো থুরথুরে ভিখারিনী নারী, রাক্ষসের মত দেখতে, একমাথা ভর্তি সাদা চুল, পরনে ছিল একটা ছেঁড়া নোংরা কাপড় , আর শরীরে জরানো রয়েছে তুলোর এক চিটচিটে কম্বল। তার হাতে ছিল একটা ছোট্ট লাঠি।
গল্পের শেষে দেখা যায় বৃদ্ধার মৃতদেহটি কে নিয়ে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সশস্ত্র সংঘর্ষে মেতে উঠেছিল। হঠাৎ মাথায় শায়িত বৃদ্ধা জনতার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হেসে উঠেছিলেন। তারপর বৃদ্ধাকে হিন্দু না মুসলমান একথা জিজ্ঞাসা করা হলে বৃদ্ধা বলেছেন চোখের মাথা খেয়েছিস মিনসেরা , দেখতে পাচ্ছিস না। এই বলে ভিড় সরিয়ে বৃদ্ধা নড়বড় করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই ভাবে গল্পে বৃদ্ধার স্বরূপের উদঘাটন হয়েছে।
(৪) ভারতবর্ষ নামক ছোটগল্পে বৃদ্ধার চরিত্রের বর্ণনা দাও।
উঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ রচিত ভারতবর্ষ নামক ছোটগল্পটি এক অসামান্য সৃষ্টি। তিনি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মনোভাব দেখাতে গিয়ে এক থুরথুরে কুঁজো ও মৃতবত বৃদ্ধার চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। এই বৃদ্ধার চরিত্র কতখানি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে তা আলোচনা করা হলো।
পৌষ মাসে অকাল দুর্যোগে এই বৃদ্ধা যখন চায়ের দোকানে চা পান করতে এসেছিল। তখন সেই দোকানে আড্ডা ধারি লোকেরা বৃদ্ধাকে কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞাসা করলে বৃদ্ধা মেজাজ এর সঙ্গে বলেছেন, সে কথায় তোমাদের কাজ কি বাছাড়া। এই উক্তির মধ্য দিয়ে বৃদ্ধার মেজাজি স্বভাব এর পরিচয় পাওয়া যায়।
গল্পংশে বর্ণিত বৃদ্ধার ছিল যথেষ্ট আত্মসম্মানবোধ। চায়ের দোকানে চা পান করে ন্যায্য মূল্য দিয়ে বৃদ্ধা যখন সেই দুর্যোগের মধ্য দিয়ে বাইরে আসছিল তখন একজন জানায় যে সে নির্ঘাত মরবে। এ কথা শুনে বৃদ্ধা তার এবং তার শতগুষ্টির মৃত্যু কামনা করেন। এর মধ্য দিয়ে তার ব্যক্তিত্বসম্পনারি পরিচয় পাওয়া যায়।
মারমুখি হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মাঝে থেকে বাশের মাচাতে ফ্যাকফ্যাক করে হেসে দুই সম্প্রদায়ের বিবাদকে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বৃদ্ধার রসিকতা বোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায়, লেখক এই বৃদ্ধার চরিত্রের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ তার দিকটি স্পষ্ট করে তুলেছেন। কারণ বৃদ্ধাকে হিন্দু না মুসলমান জিজ্ঞাসা করা হলে বৃদ্ধা বলে চোখের মাথা খেয়েছিস মিনসেরা দেখতে পাচ্ছিস না। সুতরাং বৃদ্ধা চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন। তাই এদিক থেকে বৃদ্ধা চরিত্রটি একটি সার্থক চরিত্রে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.