বিজন ভট্টাচার্য/জীবনানন্দ দাশ/উৎপল দত্তের অবদান আলোচনা কর
Jibonananda das/vijan Bhattacharya/Utpal Dutta
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
(১) রবীন্দ্রত্তর কাব্যধারায় কবি জীবনানন্দ দাশের মূল্যায়ন করো।
উঃ রবীন্দ্রত্তর ধারায় যে সমস্ত আধুনিক কবি উঠে এসেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি জীবনানন্দ দাশ।যিনি রবীন্দ্র রোমান্টিক পর্বের প্রথম আধুনিকতার নিজস্ব সুর এনেছিলেন। সমকালীন যুগ সংকট ও যুগ সংশয় কে নিজস্ব কবি চেতনায় উপলব্ধি করে কবিতা রচনা করেছেন।
এই কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল 'ঝরা পালক' (১৯২৭ এটি কবি জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ), 'ধূসর পান্ডুলিপি' (১৯৩৬), 'বনলতা সেন' (১৯৪২), 'মহা পৃথিবী' (১৯৪৪), 'রূপসী বাংলা' (১৯৭১ মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়), প্রভৃতি। 'ঝরাপালক' কাব্য থেকেই কবি নিজস্ব ভাবনার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু সমসাময়িক যুগের সংকটকে যখনই উপলব্ধি করেছেন তখনই এক গভীর শূন্যতা বোধ কবিকে গ্রাস করে নিয়েছে। এই পরিণতি ধূসর পান্ডুলিপি থেকে শেষ কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত উত্তোরন ঘটেছে। এই সমস্ত কাব্যে কখনো প্রকৃতি প্রেম কখনো নিঃসঙ্গ ও ক্লান্তি প্রধান হয়ে এই জগত জীবন শূন্য হয়ে উঠেছে। 'ধূসরপাণ্ডলিপি' কাব্যগ্রন্থের 'বোধ' কবিতায় পাই-
"সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রা দোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?"
কবি রোমান্টিক স্বপ্ন জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক চরম শূন্য ময় অনুভূতিকেই বড় করে তুলেছেন। 'বনলতা সেন' কবিতাতেও এক অনন্ত অন্ধকার কাল চেতনার ছবি প্রকাশিত হয়, যখন কবি এই কবিতার শেষ লাইনে বলে -
"থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন"।
রবীন্দ্রনাথ কবি জীবনানন্দের কবিতা পড়ে 'চিত্ররুপমায়' বলে অ্যাখা দিয়েছেন। রবীন্দ্রত্তর অর্থাৎ কল্লোল কবি গোষ্ঠীর পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি যে কবিতা, কাব্য রচনা করেছেন তাতে জীবনানন্দ দাশই যথার্থ আধুনিক কবি হিসেবে তথা আধুনিকতম বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। নিজস্ব ভাষা শব্দ ছন্দ এবং রূপক ধর্মী কিছু অতীত কাহিনী কে কবিতার মধ্যে স্থান দিয়ে নিজেকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। একদিকে এই বাংলার প্রতি রোমান্টিকতার প্রতি আকর্ষণ, অন্যদিকে সমসাময়িক যুগের সংকট কবিকে একেবারে আধুনিক কবি করে তুলেছেন।
(২) গণনাট্য আন্দোলনের ধারায় বিজন ভট্টাচার্য ও উৎপল দত্তের অবদান আলোচনা করো।
উঃ বিংশ শতাব্দীর চারের দশকে বাংলা নাটকে গণনাট্য আন্দোলনের জয়যাত্রা শুরু হয়। এই আন্দোলনের ধারায় সাধারণ অবহেলিত ও শোষিত মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিজন ভট্টাচার্য এবং উৎপল দত্ত শোষিত মানুষকে নাটকের বিষয়বস্তু করে তা গণজীবনের সঙ্গে যুক্ত করেছে।এই দুই নাট্যকারের নাটকগুলি গণনাট্য ও নবনাট্যের ধারায় কতখানি সাফল্য পেয়েছে দেখা যেতে পারে।
বিজন ভট্টাচার্য :- (১৯১৭-১৯৭৮ খ্রিঃ)
বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক 'আগুন' (১৯৪৩), তবে তার উল্লেখযোগ্য নাটক 'নবান্ন' (১৯৪৪), এই নাটক অবলম্বনে বিজন ভট্টাচার্য গণনাট্য ধারার জনক হয়ে উঠেছেন। সাধারণ মানুষ কেমন করে শোষিত হতে থাকে এবং শিক্ষিত চেতনায় নিজেদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের সবকিছু কেমন করে ফিরে পায় তার এই দণ্ডময় জীবনকে এই নাটকে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি 'দেবী গর্জন' (১৯৬৬), 'যাত্রাপথ' (১৯৭২) প্রভৃতি নাটকেও বিজন ভট্টাচার্য সর্বহারা মানুষের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তাদের ফিরে পাওয়ার আশা টুকু প্রকাশিত করেছেন।
বিজন ভট্টাচার্য গণনাট্য চেতনাকে দুটি একাঙ্ক নাটকের মধ্য দিয়েও তুলে ধরেছেন। যথা 'জননেতা', 'কলঙ্ক' এতে সাম্যবাদী রাজনীতির প্রচার এবং অর্থনৈতিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই মূল উদ্দেশ্যই গণনাট্য আন্দোলনের ভাবধারাকে প্রচারের কাজে লাগিয়েছেন। এই প্রচারে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে 'শ্রীরঙ্গম' রঙ্গমঞ্চে যখন নবান্ন নাটক প্রথম অভিনীত হয় তখন থেকেই গণনাট্য আন্দোলন বিশেষ সাফল্য পায়।
উৎপল দত্ত :- (১৯২৮ - ১৯৯৩)
গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অপর আরেক সফল নাট্যকার হলেন উৎপল দত্ত। তিনিই প্রথম গ্রুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন ও গণ আন্দোলনকে জোরদার করেছিলেন। এই ধারায় উৎপল দত্ত যে নাটক গুলি রচনা করেছিলেন তা প্রচলিত নাট্যধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চরিত্র পরিকল্পনায়, ঘটনা ব্যবস্থাপনায় এবং মঞ্চ সজ্জায় বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। উৎপল দত্তের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো 'ছায়ানট'(১৯ ৫৮), 'অঙ্গার' (১৯৫৯) 'ঘুম নেই' (১৯৬১), 'টিনের তলোয়ার' (১৯৬৪ এটি উৎপল দত্তের শ্রেষ্ঠ নাটক), 'ফেরারিফৌজ'( ১৯৭৯),'কাকদ্বীপে একমা' (একাঙ্ক) প্রভৃতি।
উৎপল দত্ত তার নাটক গুলির মধ্যে সাধারণ শোষিত মানুষের জীবনকে নাট্যকীয় দন্ডে প্রকাশ করেছেন। চরিত্র উপস্থাপনায় একেবারে নিচু তলার মানুষকে জায়গা দিয়েছেন। মঞ্চসজ্জায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংগতি থেকেই ভাষা ব্যবহারে তিনি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকেই বেশি ব্যবহার করেছেন।সাহিত্যগুণের থেকে সমাজ জীবনে ও রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের আর্থ সামাজিক ভাবনাকেই তুলে ধরা হয়েছে। তাই উৎপল দত্তের নাটকগুলি গণ অর্থে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যথার্থই গণনাট্য হয়ে উঠেছে।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.