হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা কর
৫) হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা কর।
উঃ হরপ্পা সভ্যতায় খননকার্যের ফলে যেসব প্রত্নসামগ্রী আবিস্কৃত হয়েছে সেগুলির উপর ভিত্তি করে এই সভ্যতার সামাজিক জীবনের প্রতি আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়। প্রাপ্ত উপাদানগুলি থেকে হরপ্পা সভ্যতার বাসিন্দাদের খাদ্য, পোষাক পরিচ্ছদ, গৃহস্থালির দ্রব্য, অবসর বিনোদনের উপকরণ, শিলমোহর, লিপি প্রভৃতি সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়।
শ্রেণী বৈষম্যঃ
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর নগর বিন্যাস দেখে ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেছেন যে, হরপ্পার সমাজে শ্রেণী বৈষম্য ছিল। বাড়ি গুলির আয়তন ও কবরের প্রকারভেদ এই শ্রেণী বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। হরপ্পা সভ্যতায় সমাজে সম্ভবত তিন শ্রেণীর মানুষ বসবাস করত-- ক) উচ্চবিত্ত,খ) মধ্যবিত্ত ও গ) নিম্নবিত্ত।
ক) উচ্চবিত্তঃ উচ্চবিত্ত অর্থাৎ প্রথম শ্রেণীতে ছিল পুরোহিতরা। সমাজের পুরোহিত শ্রেণীর আধিপত্য সবচেয়ে বেশি ছিল বলে হুইলার মনে করেন। তারা ছিল শাসক গোষ্ঠীর মানুষ।
খ) মধ্যবিত্তঃ
সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ছিল ধনী, বণিক, বুর্জোয়া, কারিগর ও যোদ্ধারা।সুমেরু ও মিশরের চেয়ে হরপ্পা সভ্যতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তাদের অবস্থাও ছিল বেশ সচ্ছল।
গ) নিম্নবিত্ত ঃঃ
দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকরা ছিল নিম্নবিত্ত। একেবারে নিচে ছিল অগণিত ক্রীতদাস।
খাদ্যঃ
হরপ্পা সভ্যতা মূলত ছিল কৃষি নির্ভর। শহরগুলির চারিদিকের গ্রাম অঞ্চলের কৃষি জমিতে চাষবাস হত। মানুষ নিরামিষ এবং আমিষ উভয় প্রকার খাদ্যই খেতো। গম ও যব ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। এছাড়া ভাত, ফলমূল, মটর, খেজুর, বাদাম, শাকসবজি, দুধ প্রভৃতি তারা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। তাদের আমিষ খাদ্যের মধ্যে ছিল মাছ, ডিম, মুরগি, গরু, ভেড়া এবং অন্যান্য পাখির মাংস।
পশুপালনঃ
গরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ, উট ,শুকর ছিল হরপ্পার অধিবাসীদের গৃহপালিত পশু। সম্ভবত মহিষ ও ষাঁড়কে চাষের কাজে লাগানো হতো। তবে ঘোড়াকে তারা পোষ মানাতে পেরেছিল কি না সে বিষয়ে সংশয় আছে। বাঘ, হাতি, বাইসন, গন্ডার, খরগোশ প্রভৃতি পশুর সঙ্গেও তারা পরিচিত ছিল।
পোশাক ও অলংকারঃ
সিন্ধুর অধিবাসীরা সুতি ও পশমের পোশাক পরিধান করত। দেহের উপরের অংশ এবং নিচের অংশের জন্য তারা দুই খন্ড বস্ত্র ব্যবহার করত। স্ত্রী ও পুরুষ সকলেই লম্বা চুল রাখত। পুরুষরা হার, বালা, দুল প্রভৃতি অলংকার ব্যবহার করত। নারীরা নানা ধরনের খোঁপা বাঁধতো। তারা সোনা, রুপা এবং দামী পাথরের বিভিন্ন অলংকার ব্যবহার করতো। অলংকারের মধ্যে ছিল কানের দুল, চুরি, আংটি, নথ কোমরবন্ধ, মালা, পায়ের মল প্রভৃতি।
গৃহস্থালির সরঞ্জামঃ
সিন্ধু সভ্যতায় মাটি, পাথর, তামা, ব্রোঞ্জ, কাঠ প্রভৃতির তৈরি বাসনপত্র ও গৃহস্থালির নানা সামগ্রী পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো থালা, বাটি ,আয়না চিরুনি, কাঁচি, চেয়ার, খাট ,মাদুর ইত্যাদি। পাথর, তামা, ব্রোঞ্জ প্রভৃতি তৈরি অস্ত্র পাওয়া গেছে।
আমোদ প্রমোদঃ
হরপ্পার মানুষ আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে অবসর সময় কাটাতো। এখানে শিশুদের জন্য নানা ধরনের খেলনা পুতুল মূর্তি ঝুমঝুমি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। সাধারণ মানুষের আমত প্রমোদের মাধ্যম ছিল পাষা জাতীয় খেলা শিকার সারের লড়াই রথ চালনা মাছ ধরা ইত্যাদি অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি গুলির শৈল্পিক দেহ ভঙ্গিমা লক্ষ্য করে ঐতিহাসিক ব্যাসাম এবং ঐতিহাসিক হুইলার মন্তব্য করেছেন যে, সমাজে দেবদেবী প্রথা ও নৃত্য গীতের প্রচলন যথেষ্ট চিত্রাকর্ষক ছিল।
সিলঃ
সিন্ধু উপত্যকায় তামা, ব্রোঞ্জ ও পোড়া মাটির তৈরি অন্তত ২০০০ সিল পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যই এই সিল গুলি তৈরি হতো। হরপ্পার সিলমোহর ও মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন নগরে আবিষ্কৃত হয়েছে অঙ্কিত জীবজন্তু ও জলযানের চিত্র থেকে অনুমান করা যায় যে সিন্দবাসী এইসব জীবজন্তু ও জল জলের সঙ্গে পরিচিত ছিল।
লিপিঃ
সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত সীলমোহরগুলিতে বিভিন্ন চিত্রলিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। এগুলি সিন্ধুলিপি নামে পরিচিত। এগুলি দেখতে প্রাচীন সুমেরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপির মতো। এতে ২৭০ টি অক্ষর আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু আজও পর্যন্ত সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কোনদিন এই লিপির পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হলে হরপ্পা সভ্যতার বহু অজানা ইতিহাস জানা যাবে।
সমাজে নারীর স্থানঃ
সিন্ধু সভ্যতায় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজে নারীদের বিশেষ সম্মান ছিল। খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত বেশ কিছু অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি দেখে ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে এই সভ্যতায় মেয়েরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতো। তাছাড়া সিন্ধু সভ্যতার সমাজে প্রাপ্ত নারীমূর্তি গুলির কোন কোনটির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই সমাজের নারী জাতির সম্মান ও প্রতিপত্তির প্রমাণ দেয়।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.