হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা কর
৩) প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা কর।
উঃ ভূমিকাঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাচীন সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ভারতের সিন্ধুনদের উপত্যকা অঞ্চলে এই সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। সিন্ধু সভ্যতা প্রাচীন সুমেরীয় মেসোপটেমিয়া মিশরীয় চৈনিক প্রভৃতি সভ্যতা গুলির সমসাময়িক ছিল।
আবিষ্কার হরপ্পাঃ
হরপ্পখ সভ্যতা আবিষ্কারের ফলে প্রমাণ হয় যে, বৈদিক সভ্যতার পূর্বে এবং বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতা গুলির সমসাময়িককালে ভারতে নগর সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। চার্লস ম্যাসন ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এরপর কানিংহাম ১৮৫৩ ও ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বেশ কয়েকবার হরপ্পা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক নির্বাচন সংগ্রহ করেন। তিনি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে একটি সিলমোহর আবিষ্কার করেন। পরবর্তী জেলার ইরাবতী নদীর তীরে হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুপ্রদেশর লারকান জেলায় এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
প্রধান কেন্দ্র সমূহঃ
বহুদূর বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে হরপ্পা সভ্যতা বিকাশ ঘটেছিল এখানে অন্তত ১৫০০ কোটি কেন্দ্র ছিল এই সভ্যতার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলি হল হরপ্পা মহেঞ্জোদারো কালি বঙ্গান রুপার লোথাল ইত্যাদি।
হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যঃ
হরপ্পা সভ্যতা প্রাচীন ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়। এখানকার উন্নত রাস্তাঘাট, পয়ঃপ্রনালী, স্নানাগার,শস্যাগার, ঘরবাড়ি ইত্যাদি এই সভ্যতাকে শুধু প্রাচীন ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে বিশিষ্টতা দান করেছে। এই নগর সভ্যতার বৈশিষ্ট্য গুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-
প্রাচীনত্বঃ
হরপ্পা সভ্যতার সূচনা এবং অবলুপ্তি কবে ঘটেছিল তা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতবিভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিক গ্যাড, ফ্যারি হরপ্পা সভ্যতার বিকাশ কাল হিসাবে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দকে চিহ্নিত করেছেন। স্যার মার্টিমার হুইলার হরপ্পা সভ্যতার সূচনাকাল হিসাবে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দকে চিহ্নিত করেছেন।
বিস্তারঃ
প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা সিন্ধু নদের অববাহিকা অঞ্চল ছাড়াও বহুদূর বিস্তৃত ছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অন্তত ১৫০০ টি কেন্দ্রে এই সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ এই হরপ্পা সভ্যতার আয়তন ছিল প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে হরপ্পা সভ্যতার আয়তন অন্তত ২০ গুন বেশি ছিল।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের সভ্যতাঃ
হরপ্পা সভ্যতায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে বিভিন্ন মাটির পাত্র, সীলমোহর প্রভৃতি পাওয়া গেছে। বিভিন্ন নিদর্শনের গায়ে লিপিও খোদাই করা আছে। কিন্তু এই লিপির পাঠোদ্ধার করা আজও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এই জন্য এই সভ্যতাকে প্রাক- ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতা বলে চিহ্নিত করা হয়।
তাম্র- প্রস্তর যুগের সভ্যতাঃ
হরপ্পা সভ্যতায় মানুষ বিভিন্ন লোহার ব্যবহার জানতো না। এখানকার বাসিন্দারা বিভিন্ন হাতিয়ার ও অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরির জন্য পাথর এবং ভাষা ব্যবহার করত। এজন্য এ সভ্যতাকে তাম্র প্রস্তর যুগের সভ্যতা বলা হয়। পরবর্তীকালে এখানে তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু হয়।
নদীমাতৃক সভ্যতাঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মতো হরপ্পা সভ্যতাও নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। সিন্ধুসহ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য কয়েকটি নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে এই সভ্যতার প্রসার ঘটেছিল। রাভি বা ইরাবতী, ঘর্ঘরা, ভোগাবর প্রভৃতির নদী ছাড়াও বিভিন্ন শাখানদী ও উপনদী অববাহিকায় এই সভ্যতার প্রসার ঘটেছিল। এজন্য হরপ্পা সভ্যতাকে নদীমাতৃক সভ্যতা বলা হয়।
নগর পরিকল্পনাঃ
হরপ্পা সভ্যতা ছিল একটি সুপ্রাচীন নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা। নাগরিকদের রুচিবোধ, কর্মপ্রচেষ্টা ও দক্ষতার দ্বারা এই সভ্যতা এক উন্নত নগর সভ্যতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো এই দুটি স্থানে উন্নত নগর সভ্যতার নিদর্শন মিলেছে। এখানে সুবিন্যস্ত রাস্তাঘাট, রাস্তার পাশে পয়ঃপ্রণালী, পরিকল্পিত ঘর-বাড়ি, স্নানাগার,শস্যাগার প্রভৃতি নাগরিক সুযোগ সুবিধাগুলির অস্তিত্ব ছিল। স্বাস্থ্ সচেতনতা, আধুনিক রুচিবোধ প্রভৃতি বিষয়গুলি এই নগর সভ্যতায় যথেষ্ট গুরুত্ব পেত।
৪) হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে যাহা জানো লেখো।
উঃ হরপ্পা সভ্যতার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রেই উন্নত নগর জীবনের বিকাশ ঘটেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সভ্যতার অন্যতম নগর গুলি ছিল হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান, চানহূদারো, আলমগীরপুর, লোথাল প্রভৃতি ।প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বিকশিত হওয়া এই সভ্যতায় উন্নত রাস্তাঘাট, পয়ঃপ্রণালী প্রভৃতি নির্মাণ কৌশল উন্নত নগর সভ্যতারই পরিচয় বহন করে। এই সভ্যতার নগর পরিকল্পনার প্রধান দিক গুলি হল -
জীবনযাত্রার সাদৃশ্যঃ
হরপ্পার বিভিন্ন নগর গুলিতে সমাজ ও সংস্কৃতি মোটামুটি একই ধরনের ছিল। বিভিন্ন নগরের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকলেও নগরগুলির পরিকল্পনা, গঠন রীতি জীবনযাত্রা প্রণালী প্রভৃতির মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়। নগরে রাস্তাঘাটের নকশা, ঘরবাড়ি, অট্টালিকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি নজর মোটামুটি একই ধরনের ছিল।
রাস্তাঘাটঃ
হরপ্পা সভ্যতার প্রধান রাস্তাগুলি শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাস্তা গুলি ছিল প্রশস্ত, সোজা এবং পরিচ্ছন্ন। রাস্তাগুলি ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া ছিল । প্রধান রাস্তা থেকে একাধিক সরু গলিপথ বেরিয়ে যেত। রাস্তাগুলি সম্পূর্ণ নগরকে বিভিন্ন বর্গাকার বা আয়তাকার ক্ষেত্রে বিভক্ত করত। রাস্তা নির্মাণে চুন ,সুরকি, পাথর প্রভৃতি ব্যবহার করা হতো।
ঘরবাড়িঃ
হরপ্পা সভ্যতার শহর গুলিতে গৃহ নির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগুনে পোড়ানো ইট এবং কোন কোন ক্ষেত্রে রোদে শুকানো ইট ব্যবহার করা হতো।ইটগুলি সাধারণত পাতলা ও ছোট আকৃতির হত। বাড়িতে প্রবেশের জন্য গলিপথ থাকতো বাড়িগুলি প্রাচীর বেষ্টিত থাকতো। বাড়িগুলির রাস্তার দিকে কোন দরজা জানালা থাকতো না ।ফলে দিনের বেলায় আলোর অভাব হতো। প্রতিটি বাড়িতে স্নানঘর, রান্নাঘর, সবার ঘর প্রভৃতি থাকতো। শহরে অসংখ্য দ্বিতল বাড়ি ছিল। মনে করা হত উঁচু স্থানের বাড়িগুলিতে ধনী ব্যক্তিরা এবং নিচুস্থানের বাড়িগুলিতে সাধারণ মানুষ বসবাস করত।
স্নানাগারঃ
মহেঞ্জোদারোর দুর্গ অঞ্চলে ১৮০ ফুট দীর্ঘ এবং ১০৮ ফুট প্রশস্ত একটি বিরাট বাঁধানো স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই জলাশয়টি ৩৯ ফুট লম্বা ২৩ ফুট চওড়া এবং ৮ ফুট গভীর ছিল। স্নানাগারটিতে ওঠা নামার জন্য দুদিক থেকে সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল। গ্রীষ্ম ও শীতকালে প্রয়োজন অনুসারে এখানে ঠান্ডা ও গরম জলের ব্যবস্থা করা যেত। জলাশয়ের এক পাশে কয়েকটি ছোট ছোট ঘর ছিল। সম্ভবত স্নানের পর পোশাক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে এই ঘরগুলি ব্যবহার করা হতো।
শস্যাগারঃ
হরপ্পাসহ বেশ কয়েকটি শহরে শস্যাগারের নিদর্শন মিলেছে। হরপ্পার শসাগরটি ২০০ × ১৫০ বর্গফুট উঁচু একটি ভিত্তির ওপর অবস্থিত ছিল। পাশে শ্রমিকদের বস্তির মতো ঘর ছিল। শস্যাগারটি হরপ্পা সভ্যতায় সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানার ইঙ্গিত বহন করে। ঐতিহাসিক ব্যাসাম এই শসাগারকে বর্তমান কালের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে আপাতকালীন সময়ের জন্য খাদ্যশস্য মজুত থাকতো।
নগর দুর্গঃ
মহেঞ্জোদারোয় ৪০ ফুট উঁচু একটি ডিপির উপর একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা দুর্গটি নগরের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, দুর্গ অঞ্চলের বাড়িগুলিতে শাসক শ্রেণীর লোকজন বসবাস করত। কেউ কেউ মনে করেন যে, এই নগর দুর্গ আসলে ছিল এই সভ্যতার পুরোহিত শাসকের রাজপ্রাসাদ।
পয়ঃপ্রণালীঃ
হরপ্পা সভ্যতার রাস্তাগুলির দু-ধারে বর্তমান কালের মতো উন্নত পয়ঃপ্রণালী ছিল। বাড়ির নোংরা জল প্রণালীর সাহায্যে বাইরে বেরিয়ে যেত। প্রণালী গুলির ওপরে পাথরের ঢাকনা বসানো থাকতো। ঐতিহাসিক ব্যাসাম মনে করেন,-" রোমান সভ্যতার আগে অন্য কোন প্রাচীন সভ্যতায় এত সুদক্ষ প্রয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা ছিল না"।
ডাস্টবিনঃ
শহরের বাড়িগুলির সামনে ইট দিয়ে বাঁধানো ডাস্টবিন থাকতো। বাড়ির যাবতীয় আবর্জনা এই ডাস্টবিনে জমা হতো। সেগুলি নিয়মিত পরিষ্কারের সুব্যবস্থা ছিল।
ম্যানহোলঃ
শহরের নর্দমার সঙ্গে অনেক সময় ম্যানহোল যুক্ত ছিল। এগুলির উপরে ঢাকনা বসানো থাকতো এবং ঢাকনা খুলে নিয়মিত পরিষ্কার করা হতো। ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মার মতে পৃথিবীর আর কোন প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পার মত স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে এত গুরুত্ব দেয়নি।
রক্ষণশীলতাঃ
ঐতিহাসিক ব্যাসাম বলেছেন যে, এই সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর তীব্র রক্ষণশীলতা। খননকার্য চালিয়ে এই সভ্যতায় নয়টি স্তর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন স্তরে খননকার্য চালিয়ে মোটামুটি একই ধরনের জীবনযাত্রা প্রণালী, নগর পরিকল্পনা, ওজন প্রভৃতি সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য শেষদিকের স্তরগুলির সর্বত্রই অবক্ষয়ের ছাপ লক্ষ্য করা যায়।
।।।।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.