নজরুল ইসলাম/যতীন্দ্রনাথ জো

বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস 

History of Bengali literature

 

(১) গদ্য সাহিত্য বলতে কী বোঝো? বাংলার গদ্য সাহিত্যের বিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উঃ     গদ্যমাধ্যমকে আশ্রয় করে লেখা যেকোনো সাহিত্য ও পদ বাচ্য রচনাকেই গদ্য সাহিত্য বলা হয়।

         সাহিত্যের অন্যান্য ধারার মতো প্রবন্ধ বা গদ্য সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ অসামান্য নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। প্রবন্ধের মধ্যেও তার কলি হৃদয়ের দীপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা সমাজ,ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি ,বিজ্ঞান ও সাহিত্য প্রভৃতি নানা বিষয়কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সৃজনশীল বৈচিত্রের দিক থেকে এই রবীন্দ্রনাথের গদ্য রীতি বা প্রবন্ধগুলিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।

(ক) সাহিত্য সমালোচনা মূলক প্রবন্ধ :

               'প্রাচীন সাহিত্য' (১৯০৭), 'আধুনিক সাহিত্য' (১৯০৭), 'লোকসাহিত্য'(১৯০৭), 'সাহিত্য' (১৯০৭), 'সাহিত্যের পথে'(১৯৩৬), প্রভৃতি প্রবন্ধের নাম উল্লেখ করা যায়। এই জাতীয় প্রবন্ধের মধ্যে তিনি জাতীয় আদর্শ ও সামাজিক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন।

 (খ) সমাজ রাজনীতি ও শিক্ষামূলক প্রবন্ধ : 

            'ভারতবর্ষ'(১৯০৬)'রাজা প্রজা'(১৯০৭), 'শিক্ষা'(১৯০৮), 'শিক্ষার হেরফের'(১৯০৮), 'শান্তিনিকেতন'(১৯০৯), 'ছন্দ'(১৯৩৬), 'সভ্যতার সংকোট'(১৯৪১), এই সমস্ত প্রবন্ধ গুলিতে রবীন্দ্রনাথের একদিকে যেমন রাজনৈতিক আদর্শকে ব্যক্ত করেছেন তিনি পাশাপাশি সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যার কথা উল্লেখ করে তার সমাধানের পথ নির্দেশ করেছেন।

 (গ) ধর্ম, দর্শন ও আধ্যাত্মক মূলক প্রবন্ধ : 

           'ধর্ম'(১৯০৯), 'মানুষের ধর্ম'(১৯৩৩), ইত্যাদি। এই প্রবন্ধ গুলিতে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রেমভাষী বাউলদের আধ্যাত্ম্য সাধনা এবং ধর্মচেতনার ও তার উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়।

 (ঘ) জীবনী ও আত্মজীবনী মূলক প্রবন্ধ : 

            'জীবনস্মৃতি'(১৯১২),'আত্মপরিচয়'(১৯৩০), 'ছেলেবেলা'(১৯৪০), 'চারিত্র পূজা'(১৯০৭) এই সমস্ত প্রবন্ধ গুলিতে একদিকে যেমন আত্মজীবনী অনবদ্য ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনি মনীষীদের জীবনী রচনা মাধ্যমে তিনি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।

 (ঙ) পত্র, ডায়েরি ও ভ্রমণমূলক প্রবন্ধ : 

             'পঞ্চভূত'(১৮৯৭), 'রাশিয়ার চিঠি'(১৯৩১), 'ছিন্নপত্র'(১৯১২), 'জাভা যাত্রী পত্র'(১৯১৯) প্রভৃতি গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের লেখার রীতিতেই পত্র সাহিত্য হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। যা বাংলা সাহিত্যে হালকা লঘু ভাষায় মার্জিত রুচিতে সার্থক করে তোলা হয়েছে এই ধরনের প্রবন্ধ গুলিকে।

         রবীন্দ্রনাথের গদ্য রীতির বিচিত্র কারুকাজ প্রকাশিত হয়েছে তার বিপুল প্রবন্ধ সাহিত্যে। গীতিকবিতার মতো গদ্য নিবন্ধেও তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে।

yatindranath sengupta /Najrul Islam/Subhas Mukhapadhya 


 (২) রবীন্দ্রত্তর যুগের বিশিষ্ট কবিদের কাব্য চর্চার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উঃ       ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঈশ্বর গুপ্তের যাত্রা শুরু "খন্ড" কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে। এরপর আখ্যান কাব্য রচনায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকাব্য রচনায় মধুসূদন দত্ত এবং গীতিকাব্য রচনায় বিহারীলাল আপন প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নীতি কবি হলেন রবীন্দ্রনাথ বলে আনন্দ খোঁজে পারছিলেন না এরা বৃত্তের বাইরে এসে সমসাময়িক চিন্তা চেতনায় কবিতার রচনা করলেন। এরা রবীন্দ্র রোমান্টিকতার বিরোধিতা করে সমসাময়িক সংকটের কবি হিসাবে চিহ্নিত হলেন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নজরুল ইসলাম যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত মোহিতলাল মজুমদার কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।

   নজরুল ইসলাম : 

          বাংলা কাব্যে রবীন্দ্র বিরোধী প্রথম কবি হিসেবে 'অগ্নিবীণা'(১৯২২), 'বিদ্রোহী'(১৯২৩) বেসে হাজির হলেন নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্র প্রতিভাকে অস্বীকার না করেও আপন সুর ও স্বরের সংযোজনে তিনি বাংলা কাব্য অনুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কাব্য রীতি কোন কোন ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ,মোহিতলাল ও তার পূর্ব অনুসরী এদের মতো হলেও প্রথম মহাযুদ্ধের পরে আশা আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ- বেদনা, বিদ্রোহ- বিক্ষোভের ক্ষেত্রে নজরুল যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কবির বিদ্রোহী রূপ, দেশপ্রেম, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে যে বিদ্রোহী চেতনা রূপায়িত হয়েছে তাতে তিনি রচনা করেছেন -'অগ্নিবীণা', 'বিষের বাঁশি', 'বিদ্রোহী', 'সাম্যবাদী', 'সর্বহারা' নামক প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। মানব প্রেমিক নজরুলের বাৎসল্য রস প্রকৃতির ভাবনার মধ্যে প্রকাশ ঘটেছে -দোলন চাঁপা, ছায়া নোট, সিন্ধু হিল্লোল, প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের ন্যায় কবিতায়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় :

          রবীন্দ্রোত্তর বা রবীন্দ্র পরবর্তী কবিদের মধ্যে যারা সাম্যবাদী আদর্শকে আঁকড়ে ধরেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম। সাম্যবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ইনি বাংলা কবিতার জগতে সমাজ পরিবর্তনের আশা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই কবিতাকে তিনি সংগ্রামের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। বিদ্রোহ ও বিপ্লববাদের ধজা উড়িয়ে পদাতিক নাম নিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে তার আবির্ভাব। পদাতিক কাব্যের প্রথম কবিতাটিতে তিনি বলেছেন -

              "প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য,

                  ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ,

                চোখে তার স্বপ্নের নেই নীল মদ্য,

                 কাঠ কাটা রোদ থেকে চামড়া।"

         এমন স্পষ্ট উচ্চারণ সেদিনের পাঠক সমাজকে আলোকিত করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এরপর তিনি একে একে লিখেছেন 'অগ্নিবেশন'(১৯৪৮), 'চিরকুট(১৯৫০), 'ফুল ফুটুক না ফুটুক'(১৯৫৭), 'যত দূরেই যাই'(১৯৬২), 'কাল মধুমাস'(১৯৬৬), 'ছেলে গেছে বনে'(১৯৭২), 'যারে কাগজের নৌকা'(১৯৮৯) ইত্যাদি।

          কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় জীবনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ধূলি প্রসারিত জীবনকে যোগ করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি বলতে পেরেছেন -

                   "পথ আমাকে ভীষণ টানে"

তিনি তার কবিতায় সমকালীন জীবন সমাজ ও মানুষের বেদনা ভালোবাসাকে চিহ্নিত করেছেন। সারা জীবন সংগ্রামী সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন এবং তারা কেমন করে প্রতিষ্ঠা পাবে সেই আশার বানিও সহজ ছন্দ ময়তায় এবং গদ্য রীতিতে স্পষ্ট করেছেন -

              "শতাব্দি শেষ হয়ে আসছে -

                একটু পা চালিয়ে ভাই ; একটু পা চালিয়ে"।

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত : 

          রবীন্দ্র বিরোধী দুঃখবাদী কবি হিসেবে পরিচিত নাম যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। তার কবি দর্শন রবীন্দ্রনাথকে বিরোধিতা করে। তিনি প্রচলিত কাব্যের পথে না গিয়ে তিনি কাব্য কবিতার জগতে এক আধুনিক জগত তৈরি করেছেন। তিনি অবশ্যই দুঃখবাদী কবি তবে এ দুঃখ তার নিজের জন্য নয়। পরিচিত বাস্তবের তিনি রহস্য উন্মোচন করতে চেয়েছেন। আর যতই এই নতুন জগতের রহস্য উন্মোচন করতে চেয়েছেন ততই তিনি জড়বাদী দুঃখবাদী কবি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হলো 'মরীচিকা' (১৯২৩), 'মরুশিখা' )১৯২৭), 'মরু মায়া' (১৯৩০) 'সায়ম' (১৯৪৩), 'ত্রিয়াশা' (১৯৪৮) ইত্যাদি।

          রবীন্দ্র রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কবিতা রচনা করার জন্য তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রত্তর কবি। তবে রবীন্দ্র বিরোধীতা করলেও আধুনিক যুগের ভোগবাদ বা দেহবাদ নিয়েই কবিতায় সচ্চার হয়েছিলেন। তাই তিনি অবশ্যই দেহবাদী কবি হিসেবে বাংলা কাব্য সাহিত্যে চিহ্নিত হয়ে আছেন।


Comments

Popular posts from this blog

কর্ভাস (Carvas)প্রফেসর শঙ্কুর ডায়রি

বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা তারতম্যের কারণগুলি আলোচনা কর।

আদর্শ ফুলের গঠন চিত্র ( দশম শ্রেণী)