কে বাঁচায় কে বাঁচে-মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়
কে বাঁচায় কে বাঁচে
মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়
(১) "কে বাঁচায় কে বাঁচে" গল্পাংশ অবলম্বনে মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রটি আলোচনা কর।
উঃ যেকোনো গল্পাংশ বা যে কোনো বিষয়ের মধ্য দিয়ে লেখক জীবনের সামগ্রিক রূপের সন্ধান করেন। সেই সময় যে সমস্ত ঘটনা চরিত্র নির্মাণ করেন সেগুলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মূল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করেন। আলোচ্য গল্পাংশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানবদরদী সহানুভূতি আচরণ দেখাতে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রটি পরিস্ফুটন করেছেন। তাই এই গল্পে মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রটি কতখানি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে তা আলোচনা করা হলো।
আলোচ্য গল্পাংশে কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো মৃত্যুঞ্জয়। তাকে কেন্দ্র করে, গল্পাংশটির ক্রমপরিনতি ঘটেছে। তার চরিত্রের অন্যতম দিক হলো তিনি ছিলেন সৎ, সরল, শান্তদরদী, ভাবপ্রবণ, আদর্শবাদী এক মানুষ। রাস্তার ফুটপাতে অনাহারে মৃত্যু দেখে তিনি মানসিক প্রেরণার সঙ্গে শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে থাকেন। তিনি ভাবতে থাকে ফুটপাতে ওই বীভৎস ক্ষুধা আর মৃত্যুর রূপ। না খেয়ে মরা কি ও কেমন?ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশি না মৃত্যুর যন্ত্রণা বেশি? এর মধ্য দিয়ে তার চরিত্রের মানবদরদীপূর্ণ দিকটি ফুটে উঠেছে।
এই সমস্ত চিন্তা ভাবনায় মৃত্যুঞ্জয় একদিন পাগল হয়ে ওঠে। তিনি দেরি করে অফিসে যান ও কাজে ভুল করেন। শহরে ফুটপাতের ধারে ঘুরে বেড়ান। ডাস্টবিনের ধারে, গাছের নিচে রাতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে যারা হামাগুড়ি দিয়ে একটু ভালো জায়গা খুঁজে তিনি তাদের লক্ষ্য করেন। পাড়ায় পাড়ায় লঙ্গরখানা খোঁজে অন্নপ্রার্থীদের ভিড় দেখে, আর ভাবে যেন কারো বুকে নালিশ ,নেই প্রতিবাদ নেই। যেন সবকিছুই তারা মেনে নিয়েছে।
পরিশেষে দেখা যায় মৃত্যুঞ্জয় জীবনের প্রতি ধিৎকারে এই সমস্ত মানুষের পাশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মত তিনিও মগ হাতে নিয়ে ফুটপাতে ও লঙ্গরখানায় কারাকারি মারামারি করে খিচুড়ি খায়। আর বলে-"গা থেকে এইচি, খেতে পাইনে বাবা আমায় খেতে দাও"এসবের মধ্য দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রটি একটি সার্থক চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
(২) "ওটা পাশবিক স্বার্থপরতা"- কে কাকে কোন প্রসঙ্গে কথাটি বলেছেন? পাশবিক স্বার্থপরতা বলার কারণ কি?
উঃ প্রখ্যাত সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত "কে বাঁচায় কে বাঁচে" গল্পে মৃত্যুঞ্জয় তার সমপদস্থ কর্মচারী নিখিল কে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।
মৃত্যুঞ্জয় দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের সাহায্যের জন্য মাইনের টাকা রিলিফ ফান্ডে জমা করে দেয়। এভাবে সংসারকে উপোস রেখে দেশের মানুষকে বাঁচানো যায় না বলেই নিখিলের বিশ্বাস। তাছাড়া না খেয়ে নিজেকে মেরে ফেলা বড় পাপ বলে নিখিল মনে করে। সেই জন্য সে কাটছাঁট করে খাওয়া দাওয়া যতটা সম্ভব কমিয়েছে। বেঁচে থাকতে হলে যতটুকু খাওয়ার দরকার তাই খেয়ে বাকি অংশ সংগ্রহ করবে। কারণ সে মনে করে, ১০ জন লোককে খুন করলে যে পাপ হতে পারে তার চেয়ে বড় পাপ হলো না খেয়ে নিজেকে হত্যা করা। এই প্রসঙ্গে আলোচ্য প্রসঙ্গটি এসেছে।
পাশবিক কথার অর্থ হলো পশু তুল্য নির্মম ও অমানবিক। এতে মনুষ্যত্বের পরিচয় থাকে না। পশুরা নিজেদের পেট ভরানোর জন্য নির্মমভাবে অপরকে বঞ্চিত করেন। নির্দয়ভাবে অপরের খাবার কেড়ে নেন তারা দয়ামায়ার কোন ধার ধারে না। ঠিক সেই রকমই নিখিলের মনোভাব হল, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যতটুকু খাদ্য দরকার তা জোগাড় করার জন্য অপরে না খেতে পেয়ে মরে গেলেও সে সংগ্রহ করবে। অর্থাৎ নিজে বেঁচে থাকার জন্য অপরের প্রতি দয়া মায়া ও মমত্ব দেখানোর প্রয়োজন নেই। এই ধরনের স্বার্থপর চিন্তা অমানবিক ও পশু তুল্য। এতে মানবিক মূল্যবোধ কোনো মতেই প্রকাশ পায় না। নিখিলের এই স্বার্থপরতার প্রকাশ দেখেই মৃত্যুঞ্জয় তাকে পাশবিক স্বার্থপরতা বলেছেন।
(৩) "সেদিন আপিস যাওয়ার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখলো"- কোন দিনের কথা বলা হয়েছে? সেই মৃত্যু দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল?
উঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত কে বাঁচায় কে বাঁচে গল্পংশ থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে এখানে মৃত্যুঞ্জয় যেদিন অফিস যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে অনাহারে মৃত্যু দেখেছিল সেই দিনের কথায় বলেছেন।
গড় ভাঙসে বর্ণিত মৃত্যুঞ্জয় ছিলেন একজন সহজ সরল সৎ আদর্শবাদী মানুষ পথের ধারে ফুটপাতে অনাহারে মৃত্যু দেখা, তার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। সেই মৃত্যু দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের সুস্থ শরীর কয়েক মিনিটের মধ্যে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল হলে তার মনের মধ্যে দেখা দেয় নানা প্রতিক্রিয়া। মানসিক বেদনা বোধের সঙ্গে চলতে থাকে শারীরিক কষ্টবোধ। এইভাবে তিনি মানসিক অন্তরদন্ডে ভেঙে পড়ে অফিসে ঢুকে নিজের কুঠুরিতে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে।
পরিশেষে দেখা যায় মৃত্যুঞ্জয় কলের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে পেট ভরে ভাত, ডাল, দই, ভাজা যা কিছু খেয়ে এসেছিল তা বমি করে উগড়ে ফেলেছিল। তারপর কাঁচের গ্লাসে জল পান করে খালি গ্লাসটি টেবিলের উপর রেখে শূন্য দৃষ্টিতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই ভাবেই লেখক সুন্দরভাবে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন।
(৪) "মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির অবস্থা শোচনীয়"- মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির অবস্থা শোচনীয় কেন? এই শোচনীয় অবস্থার পরিচয় দাও?
উঃ পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত "কে বাঁচায় , কে বাঁচে" গল্পংশে মৃত্যুঞ্জয় হলেন কলকাতা শহরের একজন উচ্চপদস্থ চাকুরে। অফিস আর সংসার নিয়েই ছিল তার জগৎ। কিন্তু হঠাৎ একদিন ফুটপাতে অনাহারে মৃত্যু দেখে চমকে ওঠেন। তার অশৈশব লালিত আদর্শবোধ, নীতিবোধ তাকে পিরিত করতে থাকে। তখন তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকেন। সেই জন্যই তিনি মাইনের টাকা দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের দান করেন। এমনকি নিজেও খাওয়া কমিয়ে দেন। তারপর লঙ্গরখানায় পৌঁছে মগ হাতে পরনে ছেঁড়া কাপড় পড়ে তিনি অনুভব করেন যে কেউ তাকে দোষারোপ করছে না। যেন সকলেই নিজের দুর্ভাগ্যকে দায়ী করেছে এই অবস্থার জন্য । তাই তিনি নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে একদিন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে মিথ্যা নীতি ও আদর্শ বাদের দ্বারা চালিত হয়ে পথ হারিয়েছেন। এই ভাবেই মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল।
মন্বন্তর গ্রস্থ কলকাতাকে কেন্দ্র করেই মধ্যবিত্ত সংসারী যুবক মৃত্যুঞ্জয় স্বেচ্ছায় ফুটপাতের জীবনকে গ্রহণ করেছে। বাড়িতে প্রতি প্রাণ মমতাময়ী নারী টুনুর মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। পরিবার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যাওয়া স্বামীর অস্থিরতায় কাতর হয়ে পড়েছেন। সংসার তথা ছেলেমেয়েদের ভাবনা ছেড়ে তিনি খেতে না পাওয়া রাস্তার মানুষদের সঙ্গে মিশে গেছেন। এরকমই মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির শোচনীয় অবস্থার পরিচয় পাই।
(৫) "কে বাঁচায়, কে বাঁচে" গল্পংশের বিষয়বস্তু আলোচনা কর।
উঃ মানবদরদী, মানব প্রেমিক প্রখ্যাত সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় "কে বাঁচায়, কে বাঁচে" গল্পাংশে এক বাস্তব জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন। তিনি শহরের রাস্তার ধারে ঘুরে বেড়ানো সাধারণ মানুষের অসহায়তার করুন চিত্রটি তুলে ধরেছেন। পথের ধারে অনাহারে মৃত্যু দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে মানসিক কষ্টের সঙ্গে শারীরিক কষ্ট মিশে গিয়ে নানা পরিবর্তন ঘটেছে। আর তাকে বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্যই নিখিল সচেষ্ট হয়েছে।
মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক কষ্ট দেখে নিখিল সবকিছুই বুঝতে পারে। এবং তাকে বোঝাতে থাকে ফুটপাতের ধারে এইরকম মৃত্যু সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সে এই সব কথা না শুনে মৃত্যু যন্ত্রণায় বারবার কাতর হয়ে পড়েছে। ঘটনা ক্রমে দেখা যায় তাদের দুজনের মাইনের টাকা রিলিফ ফান্ডে জমা করে দেওয়ার কথা বলেছেন। যদিও নিখিল বলেছেন এইভাবে মানুষ বাঁচানো যায় না। কিন্তু নিখিলের যুক্তি চোখের সামনে যারা মরছে তাদের কয়েকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করার সান্তনা তো দিতে পারব।
এইভাবে দেখা যায় মৃত্যুঞ্জয়ের শারীরিক মানসিক অবস্থার সঙ্গে তার বাড়ির অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়ে। অফিসে না গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। টুনুর মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। সে নিখিলের মাধ্যমে বারবার মৃত্যুঞ্জয়ের খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু তাকে কোনমতেই বাড়িতে ফেরানো সম্ভব না।
পরিশেষে দেখা যায় মৃত্যুঞ্জয় পাগলের মত ওই সকল রাস্তার মানুষদের সাথে মিশে গেছে। তার পরনে ধূলিমাখা সিল্কের জামা, ধুতির বদলে ছেঁড়া ন্যাকরা। দাড়িতে মুখ ঢেকে গেছে। আর মগ হাতে নিয়ে লঙ্গরখানায় খিচুড়ি খাওয়ার জন্য ভিড় জমিয়েছে। এইখানে গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.