শিকার
জীবনানন্দ দাশ
(১) শিকার কবিতাটির মূল বিষয় বর্ণনা কর।
উঃ জীবনানন্দ দাশ ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমিক কবি। প্রকৃতিকে তিনি কোনো অবস্থাতেই বিসর্জন দেননি বরং কর্তব্যের বিষয়কে তুলে ধরার জন্য তিনি প্রকৃতি থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করেছেন। আলোচ্য শিকার কবিতায় তিনি একদিকে ভোরের অরণ্য প্রকৃতির অপূর্ব লেখচিত্র অঙ্কন করেছেন। অন্যদিকে মানব সভ্যতার স্বার্থ ও নৃশংসতাকে তুলে ধরেছেন।
আলোচ্য কবিতার শুরুতে ভোরবেলার অরণ্যের নির্মল ছবি বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে ভোরের আকাশের রং ঘাসফড়িং এর দেহের মতো কমল নীল। চারিদিকে পেয়ারা আর নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ। কবির অপূর্ব চেতনায় প্রকৃতি যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। হিমের রাতে শরীর গরম রাখার জন্য দেশোয়ালিরা মাঠে শুকনো অশ্বত্থ পাতায় আগুন জ্বেলেছে। কিন্তু ভোর হওয়ায় সেই আগুনের রং রোগা শালিকের হৃদয়ে বিবর্ণ ইচ্ছার মত হয়ে গেছে। এইভাবে কবি সূর্যের প্রথম আলোয় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল প্রকৃতির ছবিকে তুলে ধরেছেন।
কিন্তু পরক্ষণে শিকারির বন্দুকের গুলিতে একটি সুন্দর বাদামি হরিণের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে নৃশংস দৃশ্য তৈরি হয় সেই পটভূমিতে প্রকৃতির এই নির্মল ছবি যেন সেই নৃশংসতাকে আরো নির্মম করে তোলে। প্রকৃতির এই রূপ মানুষের লোভ লালসা ও হৃদয় হীনতার সরুপকে তুলে ধরতে সাহায্য করেছেন। প্রাণবন্ত হরিণের উষ্ণ লাল মাংস তে পরিবর্তিত হওয়া নাগরিক সভ্যতার হাতে প্রকৃতি ধ্বংসের দৃষ্টান্ত কবি দেখাতে চেয়েছেন। আসলে মানুষের চেতনা হীনতা নির্মম সত্যকে কবি এখানে তুলে ধরেছেন।
(২) শিকার কবিতা অবলম্বনে ভোরের আকাশ, গাছগাছালির রং এবং আকাশে থেকে যাওয়া একটি তারার সম্পর্কে কবির উপমা ও চিত্রকল্পের দক্ষতার পরিচয় দাও।
উঃ প্রকৃতি প্রেমিক কবি জীবনানন্দ দাশ শিকার কবিতায় একটি ভোরের দৃশ্যপট আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনার প্রসঙ্গে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ায় কিভাবে ভোরের আকাশ গাছ গাছালির রং এবং আকাশে থেকে যাওয়া একটি তারার বর্ণনার মাধ্যমে সার্থক উপমা প্রয়োগ করেছেন তা আলোচনা করা হলো।
ভোরের আকাশের রং নীল তবে গারো নীল নয়, ঘাসফড়িং এর দেহের মতো কমল নীল যা চোখকে ক্রীড়া দান করে। ভোরের শান্ত পরিবেশে স্ফুটমান আলোর সঙ্গে বেশ মানানসই। এখানে ঘাসফড়িং এর দেহের নীল বর্ণের সঙ্গে আকাশের তুলনা করেছেন তাই কবির কল্পনা এটি একটি সার্থক চিত্র গল্পে পরিণত হয়েছে।
কবি ভোরের পেয়ারা ও নোনা আতা গাছের বন্য পরিবেশেরও একটি সুন্দর উপমা প্রয়োগ করেছেন।ভোরের আলোয় সবুজ গাছগুলির রং টিয়া পাখির পালকের মতো সবুজ। তাই এখানে টিয়া পাখির পালকের সঙ্গে পেয়ারা ও নোনা গাছের তুলনা করা হয়েছে। টিয়া পাখির পালক উপমান এবং পেয়ারা ও নোনা গাছ উপমেয়।
ভোরের আকাশে আগত প্রভাতে স্ফুটমান সব তারার আলো নিভে গেছে আছে একটি তারা। রাতের অন্ধকারে তার যে দীপ্তি উজ্জ্বল্য ভোরের আলো তা ম্লান হয়ে গেছে। পাড়াগাঁড় বাসর ঘরে জেগে থাকা সবে বিয়ে হওয়া কোনে বউটি লজ্জায় রাঙ্গা গোধূলি রঙের মতো। বাসর ঘরে বর কনে কে নিয়ে আসার সময় যারা ভিড় করে হাসি ঠাট্টায় গানে জমাটি আসর বেধে ছিল তারা একে একে সবাই চলে গেছে। মেয়েটি একা বাসর জাগছে। তাই মেয়েটির মতো একা হয়ে যাওয়া আকাশের তারাটির একা হয়ে যাওয়ার মিল আছে। তাই এটিও একটি সার্থক উপমা ও চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে।
(৩) "হয়ে গেছে রোগা শালিকের বিবর্ণ ইচ্ছার মত"- মন্তব্যটির প্রেক্ষাপট শিকার কবিতা অবলম্বনে আলোচনা করো।
উঃ প্রকৃতিপ্রেমিক কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত শিকার কবিতায় মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রকৃতির এক অপূর্ব চিত্র অঙ্কন করেছেন। শীতের রাতে শরীর গরম করার জন্য দেশওয়ালিরা শুকনো অশ্বত্থ পাতার আগুন জ্বেলে ছিল। সেই আগুনের রং ম্লান হয়ে যাওয়ায় তার বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আলোচ্য সার্থক উপমাটি প্রয়োগ করেছেন।
মাঠে অশ্বত্থ পাতা জ্বালানো আগুন ভোরবেলা সূর্যের আলোয় অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। কিন্তু ভোরের আগে রাতের অন্ধকারে তার রঙ ছিল কুমকুম এর গুরোর মতো লাল টকটকে। সূর্যের লালচে আলোর আভায় তা অনেকটাই ফ্যাকাশে। সেটাকে বোঝানোর জন্যই কবি উপমার এই আশ্রয় নিয়েছেন।এটি একটি অপূর্ব বাঞ্ছনা। রংটি একটি বিমুর্ত ভাব। যা চোখে দেখা যায় না। কল্পনায় বুঝে নিতে হয়। রংটি হলো রোগা শালিকে বিবর্ণ ইচ্ছা। রোগা অর্থে শীর্ণকায় দুর্বল। উদোমহীন, অনেকটা নিস্তজ। কাজেই তা উজ্জ্বল ও দীপ্ত নয়। ম্লান, বিবর্ণ ,ফ্যাকাশে আগুনের রং এমনই বিবর্ণ ফ্যাকাশে।
(৪) একটা অদ্ভুত শব্দ এই প্রতীক ব্যবহারের সার্থকতা আলোচনা প্রসঙ্গে এর মর্মান্ত লেখ।
উঃ কবি জীবনানন্দ দাশের শিকার কবিতায় আলোচ্য চরণটি প্রতীক হিসাবে কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে। অদ্ভুত শব্দটি বিশেষ অর্থবহ। এই শব্দ প্রকৃতির সাধারণ শব্দ নয়, ইহা একটি যান্ত্রিক মারোনাস্ত্রের শব্দ। ইহা হলো বন্দুকের গুলির আওয়াজ ,যে আওয়াজে আছে ঘাতকের পৈশাচিক জীভাংসার প্রকাশ লালসা পরিতৃপ্তির জন্য প্রকৃতির বুকে সুন্দরের প্রতি মূর্তিকে নির্মমভাবে নিধন করার জন্য জঘন্য মনোবৃত্তি। এই আওয়াজ প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে সম্পূর্ণ বেমানান ও বিভৎস উদ্ভট।
অরণ্যের মুক্ত পরিবেশে বিচরণকারী সুন্দর বাদামি রঙের হরিণটি গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তার রক্তে নদীর জল মচকা ফুলের পাপড়ির মতো লাল। রাতে আদিবাসীরা শরীর গরম রাখার জন্য আগুন জ্বেলে ছিল।কিন্তু পুনরায় আগুন জ্বলল মাংস ললুপ ভদ্র মানুষের লালসা চরিতার্থের জন্য। মাংস রান্না হলে হরিণের সেই গরম মাংস নিয়ে নক্ষত্র খচিত আকাশের নিচে প্রাণভজনের আসর বসেছিল। অনেক পুরানো গল্প, গল্পকথার সঙ্গে মুখো মিশ্রিত সিগারেটের ধোঁয়ায় অরণ্য পরিবেশ আবিল।কয়েকটা বন্দুক তাদের পাশে ছড়ানো ছিটানো আছে। হিম শীতল রাতের কোলে তারা ঘুমের মধ্যেই ডুবে যায়।
যান্ত্রিক সভ্যতায় মানুষ সভ্য ও ভদ্র হলেও তার মধ্যে প্রকট হয়ে আছে লালসা ও জীঘাংসার মনবৃত্তির মানসিকতা। ফলে সে প্রকৃতির শান্তি ও সৌন্দর্যকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের প্রেম শান্তি ও সৌন্দর্যকে ধ্বংস করেছেন। প্রকৃতি শুধু শিকারের বলি হয় না। শিকার হচ্ছে মানবজাতির অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.