রামায়ণ - বাল্মীকি, রামায়নের প্রভাব আলোচনা কর
রামায়ণ- বাল্মীকি
১) ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ
রামায়ণ একাধারে ধর্মশাস্ত্র ও মহাকাব্য। তাই ভারতীয় সমাজে রামায়ণের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। এই রামায়ণ হল হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। বাল্মিকী নিজের কল্পনা ও অভিজ্ঞতাকে রামায়ণের চরিত্র গুলোর মধ্যে সমগ্র অংশে পূর্ণ করে তুলেছেন। তিনি তার কাব্য সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন-
"কামার্থগুণ সংযুক্তং ধর্মার্থগুণ বিস্তরম্
সমুদ্রমিব রত্নাঢ্যং সর্বশ্রুতিমনোহরম্।"
অর্থাৎ এই গ্রন্থ ধর্ম,অর্থ,কাম ও মোক্ষ এই চতুঃবর্গের আধার।এটি রত্নময় সমুদ্রের মতো ব্যপ্ত ও শ্রুতিমনোহর।
সমাজ জীবনে প্রভাবঃ
রামায়ণের চরিত্রগুলি সমাজে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে। সমাজে পত্নীপ্রাণ সতীলক্ষ্মী নারীকে সিতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। আবার যখন কোন মহান রাজার কথা আলোচনা করার সময় রামের নাম আছে সর্বাগ্রে। কোন অনুজ ভ্রাতাকে আমরা লক্ষণের সাথে তুলনা করি। রামায়ণের আরেকটি চরিত্র হলো হনুমান। হনুমানের বীরত্ব কাহিনী শিশু মহলকে আকৃষ্ট করে। এইভাবে সমাজে সংসারে রামায়ণের প্রভাব অক্ষুন্ন রয়েছে।
রাষ্ট্রের উপর প্রভাবঃ
বিভিন্ন রাষ্ট্রে রামায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভারতবর্ষের হিন্দী প্রধান রাজ্যগুলিতে তুলসী দাসের রামচরিত মানস বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। নেপালি ভাষায় রচিত ভনুভক্তের নেপালি রামায়ণ বেশ জনপ্রিয়। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থেও রামায়ণের কাহিনীর উল্লেখ আছে।
সাহিত্যের উপর প্রভাবঃ
সাহিত্যের ক্ষেত্রে রামায়ণের প্রভাব অপরিসীম। মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশম, সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিত, ভবভূতির উত্তরাম চরিত ও মহাবীর চরিত নামক নামক দুটি রামায়ণ অবলম্বনে রচিত নাটক পাওয়া যায়। এছাড়াও মহাকবি ভট্টি রচিত ভট্টিকাব্য, কুমারদাসের জানকীহরন, মহাকবি ভাস রচিত দুটি রামায়ণ অবলম্বনে রচিত নাটক হল প্রতিমা ও অভিষেক। এইভাবে বিভিন্ন সাহিত্যে রামায়ণ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।
ধর্মীয় জীবনে প্রভাবঃ
ভারতীয় ধর্মজীবনেও রামায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভারতের নরনারী পরম শ্রদ্ধার সাথে রাম সীতার পবিত্র নাম জপ করে।কোন দেবালয়ে রামায়ণের গান গাওয়া হয়। ভারতবর্ষের বহু জায়গায় প্রতিবছর দেশের উপলক্ষে রামোৎসব পালিত হয়। তাই ভারতবাসী রাম সীতাকে মনের মনিকোঠায় দেবতাজ্ঞানে স্মরণ করে।
উপসংহারঃ
কেবল প্রাদেশিক ভাষাতে নয়, নানা বৈদেশিক ভাষাতেও রামায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় রামায়ণ ভারতের সাহিত্যক্ষেত্রকে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করেছে। যুগ যুগ ধরে রামায়ণ ভারতীয় সমাজ জীবন , ধর্মীয় জীবন ও সাহিত্যকে প্রভাবিত করে যাবে। তাই এবিষয়ে বলা হয়েছে -
"যাবৎ স্থাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে।
তাবৎ রামায়ণী কথা লোকেষু প্রচারিষ্যতি।"
২) রামায়ণের রচনাকাল সম্পর্কে যা জান তা লেখ।
উঃ ভূমিকাঃ
প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে রামায়ণ ত্রেতাযুগে ও মহাভারত দ্বাপর যুগে রচিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে রামায়ণের কাহিনী কোথাও উল্লেখ নেই তবে বাল্মিকী রচিত রামায়ণ মহাভারত অপেক্ষা প্রাচীন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশেষজ্ঞদের অনুমান মহাভারতের সম্পূর্ণতা লাভের পূর্বে বাল্মিকীর রচনা বিশেষভাবে পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিল রামায়ণের রচনাকাল প্রসঙ্গে পন্ডিতদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামতঃ
১.জ্যাকোবি ও ম্যাকডনেলের মতে, রামায়ণ বুদ্ধের জন্মের আগে রচিত হয়েছে। তারা মনে করেন রামায়ণের রচনাকাল ৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব পূর্বাব্দ।
২.রামায়ণে যবন শব্দটি দুবার ব্যবহৃত হয়েছে। ইহা যে গ্রীকদেরই বুঝিয়েছেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। উপরন্ত উত্তর-পশ্চিম ভারতেরষ এক সময়ে যত বৈদেশিক জাতি আক্রমণ করেছিল তাদের সকলকে বোঝাচ্ছে। এর থেকে বলা যায় ভারতবর্ষে গ্রিক আক্রমণের পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল।
৩) খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পাটলিপুত্র নগরী নির্মিত হয় এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ উহা এক বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। রামায়ণে এই নগরীর কোন উল্লেখ নেই। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে পাটলিপুত্র নগরী প্রতিষ্ঠার পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল
৪.রামায়ণে কোশলের রাজধানী নাম অযোধ্যা। বৌদ্ধ ও জৈন যুগে এর নাম হয়েছিল সাকেত। সুতরাং বৌদ্ধ যুগের বহু পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল।
৫.সংস্কৃত সাহিত্যের দুই প্রাচীন মহাকবি অশ্বঘোষ ও কালিদাসের রচনা বাল্মিকীর রচনার উল্লেখ নেই এবং তার রচনারীতির বিলক্ষণ প্রভাব বিদ্যমান।
৬. রামায়ণে মিথিলা ও বিশালা নামে দুটি পৃথক নগরী ছিল। বুদ্ধের সময়ে দুটি নগরী মিলিত হয়ে একই শাসনতন্ত্রের অধীনে এসেছিল এবং ওই মিলিত রাজ্যের নাম হয়েছিল বৈশালী। এর থেকে প্রমাণ হয় বৌদ্ধ যুগের পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল।
উপসংহারঃ
বস্তুত রামায়ণের রচনাকাল নির্ধারণ করা অতি দুঃসাধ্য। তবে সাধারণভাবে অনুমান করা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পূর্বে বাল্মিকীর মূল গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। সুতরাং খ্রিষ্টাব্দ চতুর্থ শতকে যদি মহাভারতের রচনার সম্পূর্ণ হয়ে থাকে তারও দু একশত বছর পূর্বে রামায়ণ রচনা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
৩) টীকা লেখোঃ
হিতোপদেশঃ
ভূমিকাঃ
সংস্কৃত সাহিত্যে পঞ্চতন্ত্রের অনুকরণে রচিত অপর একটি গল্প গ্রন্থ হল হিতোপদেশ। পন্ডিত নারায়ণ শর্মা এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন। গ্রন্থটি সম্ভবত দশম ও একাদশ শতকের রচনা বলে মনে করা হয়।পাটলিপুত্রের রাজা সুদর্শনের শিক্ষাদানের জন্য গ্রন্থটি রচিত হয়েছে।
গ্রন্থের শ্রেণীবিভাগঃ
হিতোপদেশ নামক গ্রন্থটিকে চারটি খন্ডে ভাগ করা যায়, যথা -১) মিত্রলাভ ২) সুহৃদভেদ ৩) বিগ্রহ ও ৩) সন্ধি।
গ্রন্থের বিবরণঃ
মিত্রলাভ ও সুহৃদভেদ এই দুটি খন্ড পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলির সঙ্গে হুবহু মিল আছে। অন্যান্য ভাগগুলিরও ইতস্ততভাবে মিল দেখা যায়। মিত্র লাভে আছে অপরিচিতদের সাথে নতুন করে বন্ধুত্বের কথা। সুহৃদভেদে আছে বন্ধুত্ব নাশের কথা। সন্ধিতে আছে বৈরিতানাশের উপায় ও সহাবস্থান। আর বিগ্রহে আছে যুদ্ধ দ্বন্দ ও উপদেশ মূলক নীতি বাক্য। যেমন- বিগ্রহ ভাগের অন্তর্গত উল্লেখযোগ্য গল্পটি হলো "বীরবরের উপাখ্যান" কিভাবে বীরবর রাজা শুদ্ধ কের রাজ্যরক্ষার জন্য আত্মত্যাগ করলেন তা পাঠকবর্গকে সত্যিই অবাক করে তোলে।
উপসংহারঃ
গ্রন্থটির ভাষা খুবই সহজ এবং গল্পের কাহিনীগুলি ও অত্যন্ত ছোট আকারে লিপিবদ্ধ আছে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নীতি ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে এই গ্রন্থের কার্যকারিতা অপরিসীম। তাই আকর্ষণীয় গল্প হিসাবে পঞ্চতন্ত্রের পরেই হিতোপদেশের স্থান অনস্বীকার্য।
৪) সংস্কৃত গল্প সাহিত্যে পঞ্চতন্ত্রের স্থান নির্ণয় কর।
ভূমিকাঃ
পন্ডিত বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্র হলো একটি গল্প সাহিত্য গ্রন্থ। গল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। গল্প সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য হল গল্পের মাধ্যমে কথাচ্ছলে নীতি শিক্ষাদান। এই গল্পে রাজা অমর শক্তির মূর্খ তিন পুত্রকে শিক্ষা দানের জন্য বিষ্ণুশর্মার হাতে সমর্পণ করেন । তারই ফলস্বরূপ পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল।
গ্রন্থের শ্রেণীবিভাগঃ
এই সুমনোহর পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থটিকে পাঁচটি তন্ত্রে ভাগ করা হয়েছে। এই পাঁচটি তন্ত্র হলো- মিত্রভেদ, মিত্র প্রাপ্তি, কাকুলকীয়, লব্ধপ্রনাস, অপরিক্ষীত কারক।
মিত্রভেদঃ
এই তন্ত্রটিতে ২২ টি গল্প আছে। মূল চরিত্র হল করটক ও দমনক নামক দুই শৃগাল। পিঙ্গলোক নামক একটি সিংহ এবং সঞ্জীবক নামক একটি ষাঁড়। কিভাবে সিংহ এবং ষাঁড়ের মধ্যে বন্ধুত্ব নষ্ট হলো তা গল্পের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এখানে সাম ,দান, ভেদ ও দন্ড বিষয়ক রাজনীতির কথা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও বানর, কাঁকড়া, বক ,সিংহ প্রভৃতিকে নিয়ে অনেক উপদেশমূলক গল্প লিপিবদ্ধ হয়েছে।
মিত্রপ্রাপ্তিঃ
পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থের দ্বিতীয় তন্ত্রটি হল মিত্রপ্রাপ্তি। এই তন্ত্রে ছ'টি গল্প আছে। লঘুপতনক নামে এক কাকের সঙ্গে হিরণ্যক নামক এক ইঁদুরের বন্ধুত্ব লাভের গল্প এখানে আছে।
লব্ধপ্রনাসঃ
এই তন্ত্রটিতে ১৬ টি গল্প লিপিবদ্ধ আছে। এখানে দেখানো হয়েছে যে, লব্ধবস্তু কিভাবে বোকামির জন্য নষ্ট হয়ে যায়। যেমন 'বানরমকর কথা' গল্পে দেখা যায় এক বানরের সঙ্গে এক মকরের বন্ধুত্ব হয়েছিল। কিন্তু পরে মকরের নির্বুদ্ধিতার জন্য তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
অপরিক্ষীতকারকঃ
গ্রন্থের শেষ তন্ত্র হলো অপরিক্ষীতকারক। এই তন্ত্রে পনেরোটি গল্প আছে। এই তন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল "চার পন্ডিত মূর্খের কথা"। তারা শাস্ত্র পড়েছিল কিন্তু তার মর্ম বুঝতে পারেনা। তাই লৌকিক আচরণ না থাকায় তারা প্রতি পদে পদে হাস্যস্পদ হয়েছিল। এখানে দেখানো হয়েছে যে, সঠিকভাবে কাজ না করলে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়।
উপসংহারঃ
পন্ডিত বিষ্ণুশর্মর দক্ষতায় এবং পশুপাখির আচরণের মধ্য দিয়ে মানুষের চরিত্রের বিভিন্ন দিকগুলি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কল্পনার মৌলিকতায় এবং বর্ণনার ভঙ্গিমায় গ্রন্থটি একটি সুমনোহর গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। এই গল্পের মাধ্যমে মনোরঞ্জন ও নীতি শিক্ষা দান এই দুই উদ্দেশ্যেই পঞ্চতন্ত্রের সৃষ্টি সার্থক ।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.