১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা কর।
প্রশ্নঃ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা কর।
উঃ ভূমিকাঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য আছে। অনেকের মতে এটি ছিল নিছক একটি সামরিক বিদ্রোহ। অনেকে আবার ১৮৫৭ বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। আবার অনেকের মতে এটি ছিল নিছক একটি সামন্ত বিদ্রোহ।
সিপাহী বিদ্রোহঃ
স্যার জন লরেন্স, চার্লস রবার্ট প্রমূখ ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে এই বিদ্রোহ ছিল একটি সামরিক বিদ্রোহ। সমকালীন ভারতীয় দের মধ্যে প্রায় সকলেই এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ দেশীয় কোন রাজনৈতিক সংগঠন এই বিদ্রোহ সমর্থন করেননি। শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহের নিন্দা করেছেন। ভারতের ব্যাপক অঞ্চলে বিদ্রোহের কোন প্রভাব পড়েনি এবং দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গেও এই বিদ্রোহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। এই কারণে এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ বলা হয়।
জাতীয় বিদ্রোহঃ
ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে আলোচনা কালে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে দিস লেডি এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন এছাড়া সমকালীন ইংরেজ ঐতিহাসিক ডাব ম্যালেসন জনকে এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিশিষ্ট মনীষী কার্ল মার্কস একে জাতীয় বিদ্রোহ বলেছেন।
জাতীয় বিদ্রোহ বলার কারণঃ
এই বিদ্রোহ কেবল সিপাহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না । ভারতের বিভিন্ন স্থানের জনসাধারণের, বিশেষত অযোধ্যা রহিলখন্ড ও বিহারের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগদান করেছে। ঝাঁসির রাণি লক্ষ্মীবাঈ, নানা সাহেব প্রমূখ বহু জমিদার ও তালুকদার এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। বিদ্রোহীরা দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে ভারতে বিদেশি প্রভাব মুক্ত এক দেশীয় শাসন ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধঃ
বীর সাভার কার প্রমূখ লেখকেরা এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের তীব্রতা লক্ষ্য করলে মনে হবে ব্রিটিশ শক্তিকে ধ্বংস করাই ছিল এর একমাত্র উদ্দেশ্য। এই বিদ্রোহে উচ্চ নিচ সকল ভারতীয় রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে জাতীয় সরকার কোন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের বক্তব্যঃ
বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিক অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বিদ্রোহকে স্বাধীনতার যুদ্ধ ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলেই অভিহিত করেছেন। রজনী পাম দত্ত এই বিদ্রোহকে রক্ষণশীল ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তির বিদ্রোহ বলেছেন। ঐতিহাসিক পি সি যোশির মতে সামন্ত নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও ১৮৫৭ বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে ছিল জাতীয় সংগ্রাম।
উপসংহারঃ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ, সামন্ত বিদ্রোহ, বা সনাতন পন্থীদের বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা ঠিক হবে না। কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণ বা এনফিল্ড রাইফেলের টোটার জন্যই এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। এই বিদ্রোহ হলো মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ। বিদ্রোহীদের মধ্যে অনেকেই ছিল সাধারণ মানুষ। তাই এই বিদ্রোহের গণচরিত্রকে কখনোই একটি নির্দিষ্ট বিদ্রোহ বলে চিহ্নিত করা যায় না।
প্রশ্নঃ মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ গুলি লেখ।
উঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সংঘটিত মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পিছনে ছিল একাধিক কারণ -
ক) এই বিদ্রোহ কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং বিদ্রোহীরা সর্বত্র জনসাধারণের সহানুভূতি অর্জনের সক্ষম হননি।
খ) বিদ্রোহীদের কোন সর্বভারতীয় পরিকল্পনা ছিলনা বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল।
গ) বিদ্রোহীদের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না বিভিন্ন নেতার লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ধরনের। নানা সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল পেশোয়া পদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লক্ষ্মীবাঈ চাইতেন নিজ রাজ্যের পুনরুদ্ধার প্রভৃতি।।
ঘ) সিপাহীদের মধ্যে যোগ্য নেতার অভাব ছিল।
ঙ) বিদ্রোহীদের আধুনিক অস্ত্রের অভাব ছিল অপরদিকে ইংরেজদের গোলা বারুদ ও আধুনিক সমরাস্ত্রের কোন অভাব ছিল না।
চ) রেলওয়ে ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার ফলে ইংরেজরা যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে সক্ষম হয় ভারতীয় সিপাহীদের তার ছিল না।
ছ) ইংরেজদের নানা কূটকৌশলেও এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহের সময় ভারতীয়দের ভীতি প্রদর্শন এবং প্রয়োজনে চাকরি ও পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে বিদ্রোহের যোগদান থেকে বিরত করা হয়।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.