ইতিহাস সপ্তম শ্রেণীর দ্বিতীয় অধ্যায় প্রশ্ন ও উত্তর
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস
দ্বিতীয় অধ্যায়
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের কয়েকটি ধারা খ্রিস্টীয় সপ্তম দ্বাদশ শতক
প্রশ্নঃ গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
উঃ বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্ক ছিলেন এক বিখ্যাত শাসক। তিনি ছিলেন গৌড়ের একজন স্বাধীন রাজা। তার শাসনকালের ৬০ থেকে ৭০ বছর আগে থেকেই গৌড় ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। শশাঙ্কের আমলে গৌড়ের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
রাজ্য জয়ঃ সমগ্র গৌড় দেশে শশাঙ্ক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। উত্তর ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলির দ্বন্দের সঙ্গে তিনি অংশগ্রহণ করেন। উত্তর-পশ্চিম বারানসি পর্যন্ত তার রাজ্য বৃদ্ধি করেন। তিনি সমগ্র গৌড়দেশ, মগধ ও উড়িষ্যার এক অংশ নিজের অধীনে এনেছিলেন।
ঐক্য ও সংহতি স্থাপনঃ শশাংকই প্রথম বাংলার ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান তার এই রাজ্য জয় নীতি অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে পাল রাজারা এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
বাঙালি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাঃ প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম গৌড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শশাঙ্ক তিনি উত্তর ভারতে আংশিক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।
গৌড় তন্ত্রঃ গৌড়ে গড়ে ওঠা শশাঙ্কের আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গৌড়তন্ত্র নামে পরিচিত। গৌড়ের রাজতন্ত্র বিষয়ে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, এই রাজতন্ত্র আসলে গৌড়তন্ত্র।
শাসন ব্যবস্থাঃ তিনি কেবল রাজ্য বিজেতাই ছিলেন না। তার আমলে একটি দক্ষ শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তিনি রাজ্যের কর্মচারী এবং আমলাদের নিয়ে একটি নির্দিষ্ট শাসন প্রণালী গড়ে তুলেছিলেন।
প্রশ্নঃ ত্রিশক্তি সংগ্রাম কাদের মধ্যে হয়েছিল ? এই সংগ্রামের মূল কারণ কি ছিল ?
উঃ কনৌজকে কেন্দ্র করে বাংলার পাল, পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতিহার ও দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট বংশের মধ্যে ত্রিশক্তি সংগ্রাম হয়েছিল।
ত্রিশক্তি সংগ্রামের কারণঃ ত্রিশক্তি সংগ্রামের মূল কারণ গুলি হল
আর্থিক সুবিধালাভঃ পাল, গুর্জর প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট এই তিন রাজশক্তি কনৌজের অধিকার নিয়ে সেখানকার সম্পদের অধিপতি হতে চেয়েছিল। এর পাশাপাশি তারা উত্তর ভারতের বাণিজ্য পথগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে চেয়েছিল।
ভৌগোলিক গুরুত্বঃ গঙ্গা যমুনা দোয়াব অঞ্চলের ঠিক মাঝখানে কনৌজ অবস্থিত। অবস্থানগত সুবিধা নেওয়ার জন্যই এই তিন রাজশক্তি কোন অধিকার করতে চেয়েছিল।
সামরিক গুরুত্বঃ গঙ্গা-যমুনা দোওয়াবের মধ্যবর্তী উঁচুস্থানে কনৌজ অবস্থিত ছিল সেই কারণে জলপথ বা স্থলপথ ধরে কোন থেকে সেনা অভিযান করা ছিল অনেক সহজ ও নিরাপদ।
উপসংহারঃ হর্ষবর্ধনের সময় থেকেই কনৌজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। নদীভিত্তিক বাণিজ্য ও খনিজ দ্রব্য, আর্থিক দিক থেকে কনৌজ লোভনীয় হয়ে উঠেছিল। তাই কনৌজ শেষ পর্যন্ত কে দখল করবে এই নিয়েই অষ্টম শতাব্দীতে এই তিন রাজ শক্তির মধ্যে টানা লড়াই চলেছিল। ইহা ত্রিশক্তি সংগ্রাম নামে পরিচিত।
টীকা লেখ- কৈবর্ত বিদ্রোহঃ
উঃ বাংলায় পাল যুগে কৈবর্ত বিদ্রোহ ঘটেছিল। সেই সময়ে বাংলার উত্তর ভাগে পরিবর্তনের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যে কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা জানা যায়।
কৈবর্ত বিদ্রোহঃ পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে কৈবর্তরা উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহ করেছিল। কৈবর্তরা ছিল সম্ভবত নৌকার মাঝি বা জেলে। পাল শাসনকালে তারা বাংলার উত্তর ভাগে বসবাস করত। পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের শাসনকালে কৈবর্তরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পাল রাষ্ট্রের কর্মচারী দিব্য এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে দিব্য এই বিদ্রোহ গড়ে তোলেন। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে মহীপাল নিহত হন। মহীপালের মৃত্যুর পর দিব্য বরেন্দ্র অঞ্চল দখল করেন এবং সেখানকার রাজা হন। পরবর্তীকালে মহীপালের ছোট ভাই রামপাল দিব্যকে দমন করে বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টা চালান কিন্তু ব্যর্থ হন।
প্রশ্নঃ সুলতান মাহমুদ ভারত থেকে লুট করা ধন-সম্পদ কিভাবে ব্যবহার করেছিলেন ?
উঃ সুলতান মাহমুদ প্রায় 17 বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন ভারত থেকে তিনি যেসব ধন সম্পদ লুট করেছিলেন তা তিনি নিজের রাজ্যে ভালো কাজে ব্যয় করেছিলেন।
তার আমলে রাজধানী গজনি এবং অন্যান্য শহরকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। মসজিদ, প্রাসাদ, গ্রন্থাগার, জলাধার, খাল এবং আমুদরিয়া নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন এবং ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
প্রশ্নঃ সেন রাজাদের আদি নিবাস কোথায় ছিল ? কিভাবে তারা বাংলার শাসন কায়েম করেছিল ?
উঃ সেন রাজাদের আদি নিবাস ছিল মহীশূর তথা দক্ষিণ ভারতের কর্নাট অঞ্চল।
সেন রাজারা বংশগতভাবে প্রথমে ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং পরে তারা ক্ষত্রিয় হয়ে যান। সামন্ত সেন একাদশ শতকের কোন এক সময়ে মহীশুর থেকে রাঢ় অঞ্চলে চলে আসেন। সামন্ত সেন ও তার ছেলে হেমন্ত সেনের আমলে রার অঞ্চলে কিছুটা আধিপত্য তৈরি হয়। হেমন্ত সেনের ছেলে বিজয় সেন রার অঞ্চল গৌড় পূর্ববঙ্গ ও মিথিলা রাজ্য জয় করেসেন রাজ্যের পরিধি বাড়িয়ে তোলেন।
পরবর্তী শাসক বল্লাল সেন গোবিন্দ পালকে পরাজিত করেন। বল্লাল সেনের ছেলে লক্ষণ সেন বারাণসী এবং পুরীতে তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। এভাবেই তারা বাংলার শাসন কায়েম করেছিল।
প্রশ্নঃ মৎস্যন্যায় কি ?
উঃ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের মধ্যভাগ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় 100 বছর বাংলায় যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক অনাচার দেখা দেয় সেই পরিস্থিতিকে মাৎস্যন্যায় বলা হয়।
মাৎস্যন্যায়েরর স্বরূপঃ প্রকৃতপক্ষে মাৎস্যন্যায় বলতে দেশে অরাজক অবস্থা বা স্থায়ী রাজার সুশাসনের অভাবকে বোঝানো হয়। মাৎস্যন্যায় শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হিসেবে মাছের মতো আচরণকে বোঝায়। পুকুরের বড় মাছ যেমন সুযোগ পেলে ছোট মাছকে গিলে খায় ঠিক তেমনি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় শক্তিশালী বিত্তবান পুরুষেরা দুর্বল ও অসহায়দের সর্বস্ব আত্মসাৎ করত। এই অবস্থানই হল প্রকৃতপক্ষে মাৎস্যন্যায়।
তৎকালীন পরিস্থিতিঃ শক্তিশালী রাজতন্ত্রের পতনের পর গৃহ বিবাদ , রাজবংশের দ্রুত পরিবর্তন ও ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ছিল বাংলার তৎকালীন চিত্র। ওই সময়ে বিভিন্ন ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বণিক ও সম্ভ্রান্ত লোকেরা ইচ্ছে মতো নিজে এলাকা শাসন করতেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলার কোন কেন্দ্রীয় শাসক ছিল না।
প্রশ্নঃ শশাঙ্কের আমলে বাংলার আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল ?
উঃ শশাঙ্ক ছিলেন গৌড়ের রাজা। তার আমলে ব্যবসা-বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছিল এবং কৃষি নির্ভর অর্থনীতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ব্যবসা বাণিজ্যঃ শশাঙ্কের আমলে বাংলার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি মন্দা দেখা দিয়েছিল। ফলে সমাজে বণিকদের ক্ষমতা এবং গুরুত্ব কমে গিয়েছিল।
মুদ্রাঃ শশাঙ্কের আমলে বাংলায় সোনার মুদ্রা প্রচলিত ছিল কিন্তু তার মান কমে গিয়েছিল নকল সোনার মুদ্রা এই সময় দেখা যেত কিন্তু রুপার মুদ্রা প্রচলিত ছিল না।
কৃষিঃ শশাঙ্কের আমলে মানুষ কৃষি নির্ভর হয়ে পড়েছিল ফলে এই সময়ে যমের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল সমাজ ক্রমশ গ্রাম কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল সমাজের স্থানীয় প্রধানদের গুরুত্ব বাড়তে থাকে বণিকদের গুরুত্ব বা ক্ষমতা আগের থেকে কমে এসেছিল।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.