ইতিহাস অষ্টম শ্রেণী তৃতীয় অধ্যায়

 প্রশ্নঃ ওয়ারেন হেস্টিংস এর আমলে ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত গুলি উল্লেখ করো।

উঃ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। দেওয়ানি লাভের পর রাজস্ব ব্যবস্থার সম্পর্কে ইংরেজ কর্মচারীদের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় লর্ড ক্লাইভ প্রচলিত রাজস্ব ব্যবস্থা বহাল রেখেছিল এবং দুজন নায়ক দেওয়ানকে রাজস্ব আদায়ের ভার দিয়েছিলেন।

হেস্টিংস এর রাজস্ব সংক্রান্ত পদক্ষেপঃ 

                ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথমে দুই অত্যাচারী রাজস্ব সংগ্রহকারী নায়েব দেওয়ান রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে বরখাস্ত করেন। তার আমলেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে প্রথম ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। এই সময়ে রাজস্ব ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য একটি বোর্ড অফ রেভিনিউ গঠন করার পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের জন্য নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করা হয় এরা কালেক্টর নামে পরিচিত ছিলেন। 

ক) পাঁচশালা বন্দোবস্তঃ 

                  ওয়ারেন হেস্টিংস এর আমলে রাজস্বের পরিমাণ স্থির করার জন্য এবং সর্বাধিক রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে জমিদারদের সঙ্গে নিলামের ভিত্তিতে পাঠশালা বন্দোবস্ত বা পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পাঁচসালা বন্দোবস্তের ফলে সরকারি আয়ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং কৃষকদের ওপর প্রজার অত্যাচার আরো বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ১৭৭ খ্রিস্টাব্দে এই আইনটি পরিত্যক্ত করা হয়। 

খ) আমিনী কমিশন গঠনঃ 

                 ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন্ট হেস্টিংস বাংলার ভূমি বন্দোবস্ত ও ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য আমিনী কমিশন গঠন করেন। কৃষি জমির উর্বরতা অনুসারে রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায় করা এবং কৃষকদের উন্নতির জন্য নানা রকম ব্যবস্থা নেওয়াই ছিল আমিনী কমিশনের কাজ।

গ) একসালা বন্দোবস্তঃ 

              ১৭৭ খ্রিস্টাব্দের থেকে পাঁচশালা বন্দোবস্তের পরিবর্তে একসালা বন্দোবস্ত চালু করা হয় ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কমিটি অফ রেভিনিউ গঠিত হয় ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে এই কমিটি বাতিল করে বোর্ড অফ রিভিউ গঠিত হয়।  

উপসংহারঃ 

        ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় কৃষকদের পক্ষে মোটেই লাভজনক হয়নি। এইসব ব্যবস্থায় জমি বিক্রি করার বন্দুক দেওয়ার ও অন্যান্য হস্তান্তর করার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় কৃষকদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে।

প্রশ্নঃ টীকা লেখঃ- রেগুলেটিং অ্যাক্ট 

উঃ ভারতীয় প্রশাসনের কেন্দ্রিকরনের উদ্দেশ্যে এবং ভারতে কোম্পানির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 1773 খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং আইন পাস করে। এই আইন প্রধানত দুটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল- প্রথমটি ইংল্যান্ডে কোম্পানির গঠনতন্ত্র সম্পর্কে এবং দ্বিতীয়টি ভারতের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে। 

রেগুলেটিং আইন অনুসারেঃ 

ক) কোম্পানির ভারতীয় সাম্রাজ্যের প্রশাসনের দায়িত্ব চার জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের হাতে অর্পণ করা হয় ।

খ) গভর্নর জেনারেল ও তার কাউন্সিলের মধ্যে মতভেদ হলে অধিকাংশের মত গৃহীত হবে।

গ) যুদ্ধ ও শান্তির ব্যাপারে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ওপর গভর্নর জেনারেল ও তার পরিষদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা হয়।

ঘ) একজন প্রধান বিচারপতি ও তিনজন সাধারণ বিচারপতিকে নিয়ে কলকাতায় একটি সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন করা হয়। 

             রেগুলেটিং আইন অনুসারে ভারতে কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হন ওয়ারেন হেস্টিংস। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্টের প্রতিষ্ঠা হয়। স্যার এলিজা ইম্পে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। 

প্রশ্নঃ পিটের ভারত শাসন আইন টীকা লেখ।

উঃ ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং আইন ত্রুটিমুক্ত ছিলনা। তাই এই সব অসুবিধাগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছোট পিট ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন আইন প্রবর্তন করেন। এই আইন পিটের ভারত আইন নামে পরিচিত।

পিটের ভারত আইন অনুসারেঃ 

ক) গভর্নর জেনারেল পরিষদের সদস্য সংখ্যা চারজন থেকে কমিয়ে তিনজন করা হয়।

খ) জরুরী প্রয়োজনের ভিত্তিতে গভর্নর জেনারেল কে তার পরিষদের মতামতকে অগ্রাহ্য করার অধিকার দেওয়া হয়।

গ) দেশীয় রাজাদের সঙ্গে সম্পর্ক যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপন সেনাবাহিনী ব্যবহার সম্পর্কে স্থানীয় সভা দুটির উপর গভর্নর জেনারেলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। 

প্রশ্নঃ ওয়ারেন হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিসের বিচার বিভাগীয় সংস্কারগুলি আলোচনা কর। 

উঃ ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বণিক থেকে সৈনিকে রূপান্তরিত হয় কোম্পানি। ভারতের সাম্রাজ্য স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসনিক দায়িত্ব কোম্পানির উপর ন্যস্ত হয়। কিন্তু প্রশাসনিক পথ ছিল নানা সমস্যায় জর্জরিত। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো পূর্ণতা পায় ওয়ারেন হেস্টিংস ও কর্ণওয়ালিসের হাতে। 

ওয়ারেন হেস্টিংস এর বিচার সংস্কারঃ 

                     কোম্পানির দেওয়ানি লাভ এবং দ্বৈত শাসনের পর নবাবী আমলের দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এই অসুবিধা দূর করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। বিচার সুশাসনের জন্য তিনি বাংলাকে ৩৫টি জেলায় ভাগ করে সর্বপ্রথম জেলাভিত্তিক শাসন ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তারপর - 

ক ) প্রত্যেক জেলায় একটি করে মফস্বল দেওয়ানী আদালত ও মোফস্বল ফৌজদারী আদালত স্থাপন করেন। জেলা দেওয়ানী আদালতে কালেক্টর রা হিন্দু পণ্ডিত ও মুসলিম মৌলবীদের সাহায্যে বিচার করতেন। 

খ) জেলা ফৌজদারী আদালত দুজন মৌলভীর সহায়তায় কাজী ও মুফতিরা বিচার করতেন। 

গ) দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলার জন্য কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে দুটি সর্বোচ্চ আদালত স্থাপিত হয়। সদর দেওয়ানী আদালতে গভর্নর ও কাউন্সিলের দুজন সদস্য বিচার করতেন।

ঘ) মামলা- মোকদ্দমার কাগজপত্র সংরক্ষণ, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলার রায় প্রকাশ প্রভৃতি ব্যবস্থা করেন। 

ঙ) হিন্দুদের হিন্দু আইন অনুযায়ী ও মুসলিমদের ইসলামী আইন অনুযায়ী বিচার প্রচলিত হয়। 

কর্নওয়ালিসের আমলে বিচার বিভাগীয় সংস্কারঃ 

                ওয়ারেন হেস্টিংস এর বিচার ব্যবস্থাকে পূর্ণরূপ দিয়েছিলেন কর্নওয়ালিস তার বিচার বিভাগীয় সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- 

ক) নবাবের নিজামতি ক্ষমতা লোপ করে কোম্পানির হাতে দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলার বিচারের অধিকার দেওয়া হয়।

খ) জেলার বিচারের দায়িত্ব কালেক্টরদের হাত থেকে নিয়ে জেলা জজদের দেওয়া হয়।

গ) জেলা জজের কাজে সাহায্য করার জন্য একজন রেজিস্টার নিযুক্ত হয় তিনি ২০০ টাকা পর্যন্ত মামলার বিচার করতে পারতেন।

ঘ) ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য চারটি ভ্রাম্যমান আদালত গঠন করেন।

ঙ) সদর নিজামী আদালতকে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন।

চ) নরহত্তাকে রাষ্ট্রীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয় এবং রাষ্ট্রের হাতে হত্যাকারীর বিচারের ভার দেওয়া হয়।  

প্রশ্নঃ লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে যা জানো লেখো।

উঃ ওয়ারেন হেস্টিংসের পর লর্ড কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে আসেন। তিনি ইংল্যান্ডের প্রচলিত জমিদারি প্রথার অনুকরণে ভারতেও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করার পক্ষপাতী ছিলেন। এছাড়া রাজস্ব ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য তিনি ভারতীয় জমিদারদের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য চুক্তি করেন, যা দশ শালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে ভূমি রাজস্ব সমস্যার সমাধানের জন্য ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। 

চিরস্থায়ী ব্যবস্থার শর্তঃ 

ক) এই প্রথা অনুসারে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার জমিদার শ্রেণী বংশানুক্রমিকভাবে জমির মালিকানা ভোগ করবে। 

খ) জমিদাররা আদায়কৃত রাজস্বের ৯/১০ অংশ কোম্পানিকে ভাগ দেবে। 

গ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্বেও রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে। 

ঘ) বছরের নির্দিষ্ট দিনের সূর্যাস্তের মধ্যে রাজস্ব জমা দিতে না পারলে সেই জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হবে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফলঃ 

            চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল গুলিকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- 

অ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সুফলঃ 

   ক) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানির স্থায়ী আয় সুনিশ্চিত হয়।

খ) এই বন্দোবস্তের ফলে সংগৃহীত অর্থ থেকে  কোম্পানি তার বাণিজ্যিক বিনিয়োগের মূলধন সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়। 

গ) এই বন্দোবস্তের ফলে ভারতে একটি নতুন অভিজাত জমিদার শ্রেণী গড়ে ওঠে,যারা সরকারের প্রধান সমর্থক ছিলেন । 

ঘ) কৃষির উন্নতি ঘটে, ফলে দেশে কৃষিযোগ্য আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। 

ঙ) জমি থেকে সরকারের আয় ক্রমশ বাড়তে থাকে। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফলঃ 

ক) চিরস্থায়ী ব্যবস্থার ফলে জমিদারি থেকে জমিদারের আয় বৃদ্ধি পেলেও সরকারি আয় সেই অনুপাতে বাড়েনি। 

খ) এই ব্যবস্থার ফলে বিনা পরিশ্রমে প্রচুর পরিমাণ আয়ের অধিকারী হওয়ায় জমিদাররা প্রায়ই জমির প্রতি উদাসীন থেকে শহরের বিলাসনের মধ্যে জীবন কাটাতেন। 

গ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে অর্থনৈতিক শোষণ ও অত্যাচার কৃষকদের জীবনে হতাশা নেমে আসে। 

ঘ) এই ব্যবস্থার অন্যতম কুফল হলো পাটনী প্রথার উদ্ভব।

ঙ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে একদিকে জমিদার রাজস্ব আদায়কারী ও মধ্যস্বত্ব ভোগীরা লাভবান হয়। কিন্তু কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। 







Comments

Popular posts from this blog

কর্ভাস (Carvas)প্রফেসর শঙ্কুর ডায়রি

বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা তারতম্যের কারণগুলি আলোচনা কর।

আদর্শ ফুলের গঠন চিত্র ( দশম শ্রেণী)