বাঙ্গালা ভাষা - স্বামী বিবেকানন্দ
বাঙ্গালা ভাষা
- স্বামী বিবেকানন্দ
জন্ম ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ:: মৃত্যু ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ
আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃত সমস্ত বিদ্যা থাকার দরুন, বিদ্বান এবং সাধারণের মধ্যে একটা অপার সমুদ্র দাঁড়িয়ে গেছে। বুদ্ধ থেকে চৈতন্য রামকৃষ্ণ পর্যন্ত -যাঁরা 'লোকহিতায়' এসেছেন, তাঁরা সকলেই সাধারণ লোকের ভাষায় সাধারণকে শিক্ষা দিয়েছেন। পাণ্ডিত্য অবশ্য উৎকৃষ্ট; কিন্তু কটমট ভাষা- যা অপ্রাকৃতিক, কল্পিত মাত্র, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না? চলিত ভাষায় কি আর শিল্পনৈপুণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের ক'রে কি হবে? যে ভাষায় ঘরে কথা কও, তাতেই তো সমস্ত পাণ্ডিত্য গবেষণা মনে মনে কর; তবে লেখবার বেলা ও একটা কি কিম্ভুতকিমাকার উপস্থিত কর? যে ভাষায় নিজের মনে দর্শন-বিজ্ঞান চিন্তা কর, দশজনে বিচার কর- সে ভাষা কি দর্শন-বিজ্ঞান লেখবার ভাষা নয়? যদি না হয় তো নিজের মনে এবং পাঁচজনে ও-সকল তত্ত্ববিচার কেমন ক'রে কর? স্বাভাবিক যে ভাষায় মনোভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালোবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারেই না; সেই ভাব, সেই ভঙ্গি, সেই সমস্ত ব্যবহার ক'রে যেতে হবে। ও ভাষার যেমন জোর, যেমন অল্পের মধ্যে অনেক, যেমন যে-দিকে ফেরাও সে-দিকে ফেরে, তেমন কোনো তৈরি ভাষা কোনো কালে হবে না। ভাষাকে করতে হবে- যেমন সাফ্ ইস্পাত, মুচড়ে মুচড়ে যা ইচ্ছে কর- আবার যে-কে-সেই, এক চোটে পাথর কেটে দেয়, দাঁত পড়ে না। আমাদের ভাষা- সংস্কৃতর গদাই-লস্করি চাল- ঐ এক চাল নকল ক'রে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায়- লক্ষণ।
যদি বল ও কথা বেশ; তবে বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোনটি গ্রহণ করব? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। পূর্ব-পশ্চিম, যে দিক্ হতেই আসুক না, একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি সেই ভাষাই লোকে কয়। তখন প্রকৃতি আপনিই দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, কোন ভাষা লিখতে হবে, যত রেল এবং গতাগতির সুবিধা হবে, তত পূর্ব-পশ্চিমী ভেদ উঠে যাবে, এবং চট্টগ্রাম হ'তে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ঐ কলকেতার ভাষাই চলবে। কোন্ জেলার ভাষা সংস্কৃতর বেশি নিকট, সে কথা হচ্ছে না- কোন্ ভাষা জিতছে সেইটি দেখ। যখন দেখতে পাচ্ছি যে, কলকেতার ভাষাই অল্পদিনে সমস্ত বাঙ্গালা দেশের ভাষা হয়ে যাবে, তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে-কথা-কওয়া ভাষা এক করতে হয় তো বুদ্ধিমান অবশ্যই কলকেতার ভাষাকেই ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ এখায় গ্রাম্য অর্যাটিকেও জলে ভাসান দিতে হবে। সমস্ত দেশের যাতে কল্যাণ, সেখা তোমায় জেলা বা গ্রামের প্রাধান্যটি ভুলে যেতে হবে। ভাষা ভাবের বাহক। ভাগই প্রধান ভাষা পরে। হীরে-মোতির সাজ-পরানো ঘোড়ার উপর বাঁদর বসালে কি ভালো দেখায়? সংস্কৃতর দিকে দেখ দেখি। 'ব্রাহ্মাণে'র সংস্কৃত দেখ, শবর স্বামীর 'মীমাংসাভাষ্য' দেখ, পতঞ্জলির 'মহাভাষ্য' দেখ, শেষ- আচার্য শংকরের ভাষা দেখ, আর অর্বাচীনকালের সংস্কৃত দেখ। এখুনি বুঝতে পারবে যে, যখন মানুষ বেঁচে থাকে, তখন জেন্ত-কথা কয়, মরে গেলে মরা-ভাষা কয়। যত মরণ নিকট হয়, নুতন চিন্তাশক্তির যত ক্ষয় হয়, ততই দু-একটা পচাভাব রাশীকৃত ফুল-চন্দন দিয়ে ছাপাবার চেষ্টা হয়। বাপ রে, সে কি ধুম- দশপাতা লম্বা লম্বা বিশেষণের পর দুম ক'রে- 'রাজা আসীৎ'!!! আহা হা! কি প্যাঁচওয়া বিশেষণ, কি বাহাদুর সমাস, কি শ্লেষ!!-ও-সব মড়ার লক্ষণ। যখন দেশটা উৎসন্ন যেতে আরম্ভ হ'ল, তখন এই-সব চিহ্ন উদয় হ'ল। ওটি শুধু ভাষায় নয়, সকল শিল্পতেই এল। বাড়িটার না আছে ভাব, না ভঙ্গি; থামগুলোকে কুঁদে কুদে সারা করে দিলে। গয়নাটা নাক কুঁড়ে ঘাড় ফুঁড়ে ব্রহ্মরাক্ষসী সাজিয়ে দিলে, কিন্তু সে গয়নায় লতা-পাতা চিত্র-বিচিত্রর কি ঘুম!!! গান হচ্ছে, কি কান্না হচ্ছে, কি ঝগড়া হচ্ছে-তার কি ভাব, কি উদ্দেশ্য, তা ভরত ঋষিও বুঝতে পারেন না; আবার সে গানের মধ্যে প্যাঁচের কি হুম! সে কি আঁকাবাঁকা ডামাডোল- ছত্রিশ নাড়ীর টান তাই রে বাপ! তার উপর মুসলমান ওস্তাদের নকলে দাঁতে দাঁত চেপে, নাকের মধ্য দিয়ে আওয়াজে সে গানের আবির্ভাব। এগুলো শোধরাবার লক্ষণ এখন হচ্ছে, এখন ক্রমে বুঝবে যে, যেটা ভাবহীন প্রাণহীন- সে ভাষা, সে শিল্প, সে সংগীত কোনো কাজের নয়। এখন বুঝবে যে জাতীয় জীবনে যেমন যেমন বল আসবে, তেমন তেমন ভাষা শিল্প সংগীত প্রভৃতি গণনা-আপনি ভাবময় প্রাণপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। দুটো চলিত কথায় যে ভাবরাশি আসবে, যাদু-হাজার ছাঁদি বিশেষণেও নাই। তখন দেবতার মূর্তি দেখলেই ভক্তি হবে, গহনা-পরা মেয়ে-মাত্রই দেবী বলে বোধ হবে, আর বাড়ি-ঘর দোর সব প্রাণস্পন্দনে ডগমগ করবে।
বিষয় সংকেত
ক) 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধটি স্বামী বিবেকানন্দের 'ভাববার কথা' গ্রন্থ থেকে গৃহীত।
খ) প্রাচীনকালে কলকাতার ভাষাকে গ্রহণ করার কথা বলেছেন।
গ) ভাষা ভাবের বাহক এবং জাতীয় উন্নতির প্রধান বাহক সেই দেশের জাতীয় ভাষা।
ঘ) মীমাংসা ভাষ্য-এর লেখক শবরস্বামী।
ঙ) মহাভাষ্য-এর লেখক পতঞ্জলি।
চ) বাঙ্গালা ভাষা লেখকাট ১০০৬ বঙ্গাব্দে উদ্বোধন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ছ) চৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম এবং বুদ্ধদেব বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক।
জ) সঙ্গীত ও নাট্যশাস্ত্রের প্রথম প্রকাশক ভরতঋষি।
ঝ) স্বামী বিবেকানন্দ চলিত ও কথ্য ভাষা ব্যবহারের প্রবর্তক ছিলেন।
ঞ) সংস্কৃত ভাষায় গদাই লস্করি চাল দেখা যায়।
ট) চলিত ভাষা মনের বাহন হওয়ার গুণে প্রসার করে।
ঠ) কলকাতার হাওয়া খেলে মানুষ কলকাতার ভাষায় কথা বলে।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.