১৩৫০ এর মন্বন্তরের কারণগুলি লেখ।
প্রশ্ন: পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ ফলাফল লেখ।
ভূমিকাঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপান ব্রহ্মদেশ দখল করে ভারতের দিকে নজর দেন। এই সময় ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণের ফলে অবিভক্ত বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় অপুষ্টিতে প্রচুর মানুষ মারা যায়। খাদ্যের অভাবে অখাদ্য উপ খাদ্য খেয়ে মানুষ শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সংগঠিত হয়েছিল বলে এই দুর্ভিক্ষ পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
*পূর্ববর্তী খাদ্য সংকটঃ
অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪০ থেকে ৪১ খ্রিস্টাব্দে সীমিত আকারে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপের ফলে ব্যাপক প্রাণহানির হাত থেকে বাংলা রক্ষা পেলেও পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে বাংলার মানুষের প্রাণ শক্তি নিশ্বাস হয়ে আসে।
*খাদ্য উৎপাদন হ্রাসঃ
এই সময়ে বিভিন্ন কারণে বাংলায় খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুমান করা হয় যে, পঞ্চাশের মন্বন্তরের পূর্বে বাংলায় যে পরিমাণ ধান উৎপন্ন হয় তার পরিমাণ ছিল বিগত 10 বছরের গড় উৎপাদনের চেয়ে অন্তত ২৫ মিলিয়ন টন কম। এর কারণ হলো ঘূর্ণিঝড়, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে ধানের প্রচুর ক্ষতি সাধন হয়।
*খাদ্য সরবরাহ হ্রাসঃ
পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চাহিদার তুলনায় বাংলায় খাদ্যের যোগানের ঘাটতি। এই সময় বিভিন্ন কারণে মাদ্রাজ, উড়িষ্যা, কোচিং প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে এবং প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। সেখানকার ঘাটতি মেটাতে পাঞ্জাব ও অন্যান্য স্থানের খাদ্যশস্য প্রচুর পরিমাণে সেসব অঞ্চলের রপ্তানি শুরু হয়। এর ফলে বাইরে থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানি হ্রাস পেলে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
*বার্মা থেকে চাল আমদানি বন্ধ হওয়াঃ
বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে বাইরে থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানি করে এখানকার খাদ্যের চাহিদা মেটানো হতো। বার্মা থেকে আমদানি করা চালে বাংলার অনেকটা ঘাটতি মিটতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ইংরেজদের হাত থেকে বার্মা দখল করে নেয়। এর ফলে বার্মা থেকে বাংলা তথা ভারতের চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলায় দ্রুত চালের সংকট দেখা দেয়।
*জাপানের ভারত আক্রমণের আশঙ্কাঃ
জাপান কর্তৃক বার্মা দখলের পর ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করেছিল যে, জাপান হয়তো বাংলা হয়ে ব্রিটিশ ভারতের অভিযান চালাতে পারে। এ জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়।১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ঘোষণা করেন যে, ইংরেজরা ভারতের সীমান্ত অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সেখানকার খাদ্য ও যানবাহন নির্মমভাবে ধ্বংস করা হবে এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা হবে। এভাবে পড়ামাটি নীতির দ্বারা ভারতে জাপানি সেনাদের আক্রমণের সময় ভারতবর্ষ থেকে সমস্যায় ফেলার পরিকল্পনা করে।
*সেনার জন্য খাদ্য রপ্তানিঃ
ভারতবর্ষ তখন খাদ্য উৎপাদনে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর ছিল না। এজন্য কিছু পরিমাণ খাদ্য বাইরে থেকে আমদানি করতে হতো। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য ভারত থেকে রপ্তানি করে। ফলে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দেয়।
*তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাবঃ
খাদ্যশস্য উৎপাদন, চাহিদা ও যোগান সম্পর্কে যথার্থ পরিসংখ্যান সরকারের কাছে না থাকায় এবং তথ্যে গড়মিল থাকায় সরকার ৫০ এর মন্বন্তরের মাত্রা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে এবং তার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
*মজুতদারিঃ
জাপান বার্মা আক্রমণ করলে এবং কলকাতায় বোমাবর্ষণ করলে বাংলায় দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে সরকার সেনাদলের জন্য বাংলা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে চাল মজুত করে। তাছাড়া খাদ্য সংকটের আগাম আভাস পেয়ে বাংলার বহু ব্যবসায়ী প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য কিনে গুদামে মজুত করে। এর ফলে খাদ্য সংকট অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
*খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধিঃ
এই সময় সারা ভারতেই বিশেষ করে বাংলাতে খাদ্যশস্যের প্রচন্ড মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। এর কারণ হলো সারা ভারতে বেশ কিছু অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন কম হলে বাংলার বাজারে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়। খাদ্য সংকটের আগাম আভাস পেয়ে ধনী ব্যক্তিরা বা ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য মজুত করতে শুরু করে। ফলে বাজারে খাদ্যের যোগান আরও কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে খাদ্যশস্যের মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
*সরকারি উদাসীনতাঃ
এই দুর্ভিক্ষের জন্য যে সরকারের উদাসীনতা অনেকখানি দায়ী তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তার কারণ 1942 খ্রিস্টাব্দে বাংলার নেতা থেকেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বাংলা সরকারকে জানিয়েছিল। তা সরকার তাতে কর্ণপাত করেননি। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্য সংকট শুরু হলে বাংলার প্রাদেশিক সরকার এর মোকাবিলায় মোটেই তৎপর দেখায়নি।
Comments
Post a Comment
Haven't doubt please let me know.